দুই মাস সাগরে ভাসল রোহিঙ্গারা, মৃত ৩২

সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় টেকনাফে ফেরত আসা ট্রলারসহ ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। প্রায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসমান থাকায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গতকাল দুপুরে টেকনাফ জেটিতে।  ছবি: গিয়াস উদ্দিন
সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় টেকনাফে ফেরত আসা ট্রলারসহ ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। প্রায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসমান থাকায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গতকাল দুপুরে টেকনাফ জেটিতে। ছবি: গিয়াস উদ্দিন

করোনাভাইরাস–আতঙ্কের মধ্যে গত বুধবার রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে আসা ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর উদ্ধার রোহিঙ্গাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে।

একই ঘটনায় সাগরে অভুক্ত থেকে ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। উদ্ধার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন। প্রায় দুই মাস আগে ৪৮২ রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীদের প্ররোচনায় ‘উন্নত জীবন ও বিয়ের আশায়’ মালয়েশিয়া রওনা হয়েছিল। কিন্তু মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী তাদের সেখানে ভিড়তে না দেওয়ায় তারা আবার টেকনাফ উপকূলে ফিরে আসে। উদ্ধার রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দা।

২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানব পাচারের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপর দুই বছর মানব পাচার প্রায় বন্ধ থাকে। ২০১৮ সালে এই অঞ্চল থেকে থেমে থেমে মানব পাচার শুরু হলেও করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। উদ্ধার রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, প্রথমে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী, এরপর থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর বাধার মুখে তাঁরা বাংলাদেশের উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার রোহিঙ্গাদের প্রথমে মিয়ানমারে ‘পুশব্যাক’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রেখেছে।

পুলিশ সূত্রমতে, এর মধ্যে ২০০ জনকে রাখা হয়েছে টেকনাফের কেরনতলীর ট্রানজিট ঘাটের শরণার্থী প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে। অবশিষ্ট ১৯৬ জনকে নেওয়া হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং টিভি সম্প্রচার কেন্দ্রের আরেকটি ‘আইসোলেশন ইউনিটে’। উদ্ধার ৩৯৬ রোহিঙ্গার মধ্যে নারী ১৮২ জন, পুরুষ ১৫০ জন, শিশু ৬৪ জন।

কোস্টগার্ড ও পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা সৈকতে রোহিঙ্গাবোঝাই একটি ট্রলার ভেড়ে। এরপর ট্রলার থেকে রোহিঙ্গারা নামতে শুরু করেন। এ সময় কোস্টগার্ড ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে।

ট্রলারেই মৃত্যু

টেকনাফের জেটিঘাটে গতকাল সকালে কথা হয় উদ্ধার রোহিঙ্গা লিয়াকত আলীর (২২) সঙ্গে। তিনি উখিয়ার থাইংখালী শিবিরের বাসিন্দা। ভালো চাকরির আশায় ট্রলারে মালয়েশিয়া রওনা দেন। টেকনাফের জেটিঘাটে বিলাপ করতে করতে লিয়াকত বলেন, ট্রলারে চার দিন অভুক্ত থেকেই তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ নছিম মারা গেছেন। জানাজা ছাড়াই ভাইয়ের লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে।

অভুক্ত থেকে ট্রলারে মারা গেছে জানে আলমের চার বছরের মেয়ে। জানে আলম (৪৪) বলেন, সাগরেই হারিয়ে গেল আদরের মেয়ে।

উদ্ধার রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, ট্রলারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাত-আটজন দালালও (মানব পাচারকারীদের সহযোগী) ছিল। মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেওয়া হয় পুরুষদের। তরুণীদের দেওয়া হয় ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি।

>

টেকনাফ উপকূলে ট্রলারসহ ৩৯৬ রোহিঙ্গা উদ্ধার
ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে এসব রোহিঙ্গা

সাত দিন পর ট্রলারটি মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছালে তাদের বাধা দেয় সেখানকার কর্তৃপক্ষ। বলা হয়, এখন করোনাকাল চলছে, এই মুহূর্তে কোনো রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়া ঢুকতে দেওয়া হবে না। এরপর রোহিঙ্গাদের চালের বস্তা ও সবজি দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গত ৫০ দিন রোহিঙ্গারা ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ভাসতে থাকে। এর মধ্যে কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়েও বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তৎপরতার কারণে টেকনাফ উপকূলে ঢুকতে পারেনি।

বিয়ের আশায়

পুলিশ জানায়, উদ্ধার ১৮২ নারীর মধ্যে শতাধিক ছিল তরুণী। খুরশিদা বেগম ও আমেনা খাতুন নামের দুই তরুণী বলেন, শিবিরে আড়াই বছর ধরে অবস্থান করলেও তাঁদের বিয়ে হচ্ছে না। রোহিঙ্গা শিবিরে তরুণদের তেমন কাজকর্ম নেই। বেশির ভাগ সময় তাঁরা অলস সময় কাটান। তাই ভাগ্য ফেরানোর আশায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে ওঠেন তাঁরা। মালয়েশিয়ার গিয়ে ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় দালালেরা।

সাজেদা বেগম নামের আরেক তরুণী বলেন, মালয়েশিয়ায় থাকা এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে গত মার্চে মুঠোফোনে তাঁর বিয়ে হয়েছে। এখন সমুদ্রপথে স্বামীর কাছে ফিরছিলেন। যদিও স্বামীকে কখনো দেখেননি।

রোহিঙ্গারা জানায়, দালাল চক্র রোহিঙ্গাপ্রতি ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাঁদের টেকনাফ উপকূল থেকে ট্রলারে তুলে দেয়। মালয়েশিয়া পৌঁছালে দালালদের মাথাপিছু আরও এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল।

১ হাজার ৫৫১ জন রোহিঙ্গা উদ্ধার

কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার এম সোহেল রানা বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে শিবির থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। এর মধ্যে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সেন্ট মার্টিনে সাগরে ১৩৮ জন রোহিঙ্গা বোঝাই আরেকটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ১৯ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যরা ৭৩ রোহিঙ্গাকে জীবিত উদ্ধার করলেও ৪৬ জন নিখোঁজ ছিল।

গত বছরের ১ মার্চ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মহেশখালী, উখিয়া, রামু, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন থেকে ৪৯ দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১ হাজার ৫৫১ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষকে উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী। এ সময় ৫৪ জন দালালকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায় ৯ সন্দেহভাজন মানব পাচারকারী নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন রোহিঙ্গা ও ছয়জন বাংলাদেশি। সাধারণত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাস সাগরপথে মানব পাচার বেড়ে যায়।

টেকনাফে আতঙ্ক

করোনা সংক্রমণ নিয়ে টেকনাফ সীমান্তের মানুষ এমনিতে আতঙ্কে। এর মধ্যেই ৩৯৬ জন রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ নিয়ে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, উদ্ধার রোহিঙ্গাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখায় স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। পুশব্যাক করলে এরা আবার ফিরে আসত। এতে স্থানীয়দের ক্ষতি হতো অনেক।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।