মাদকাসক্ত স্বামীকে 'না' বলেছেন, করোনাকে কী বলবেন তমা

নিমকি বিক্রি বন্ধ। দুই সন্তানকে নিয়ে নিজের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কাঁদছেন তমা রানি পাল। ছবি: প্রথম আলো
নিমকি বিক্রি বন্ধ। দুই সন্তানকে নিয়ে নিজের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কাঁদছেন তমা রানি পাল। ছবি: প্রথম আলো

মাদকাসক্ত স্বামী জেলে যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে কঠিন লড়াই শুরু করেন তমা রানী পাল। সিদ্ধান্ত নেন, স্বামীর সঙ্গে সংসার আর নয়। সুস্থ পরিবেশে সৎভাবে মানুষ করবেন দুই সন্তানকে। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এখন তমার লড়াইকে অনেক বেশি কঠিন করে তুলেছে। সন্তানদের নিয়ে কীভাবে চলবেন, তা ভেবে দিশেহারা বোধ করছেন তিনি।

তমার (২৮) মায়ের বাড়ি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কুমারপাড়া মহল্লায়। এখানে মা সুবাশী রানী দাস ছাড়া আর কেউ নেই। মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। পাঁচ মাস ধরে আট ও দশ বছর বয়সী দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি মায়ের বাসায় রয়েছেন।

কথা হয় তমা রানী পালের সঙ্গে। তিনি জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় স্বামী জেলে যান। তিনি তখন তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসেন। নিমকি তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করেন। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করেন।

এরই মধ্যে জেল থেকে বের হয়ে স্বামী সন্তান দুটোকে কেড়ে নেওয়ার জন্য স্কুলে আসেন। খবর পেয়ে ছুটে যান তমা। তিনি স্বামীর মুখের ওপর জানিয়ে দেন, নিমকি বিক্রি করে সন্তানদের মানুষ করবেন, কিন্তু মাদকাসক্ত স্বামীর বাসায় যাবেন না।

তবে ভাগ্য বোধ হয় আরও কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি করতে চায় তমাকে। তাই তো এর পরপরই আসে করোনাভাইরাসের কাল। তমা পালের নিমকির ব্যবসা বন্ধ। শহরের ভোটার নন বলে ত্রাণও পাচ্ছেন না। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।

তমা রানী পালের বিয়ে হয় রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর এলাকার তন্ময় পালের (৩৫) সঙ্গে। তমা জানতেন, স্বামী চটপটি বিক্রি করেন। বিয়ের পর দেখেন, স্বামীকে শুধু পুলিশ খোঁজে, ধরে নিয়ে যায়। তমা জানতে পারেন যে তাঁর স্বামীর নামে ঢাকা, নাটোর ও রাজশাহীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে। স্বামী ইয়াবা সেবন করেন। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি। বিয়ের পরই সংসার চালাতে তমাকে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে হতো।

মাদকাসক্ত স্বামীর নির্যাতনের কারণে তিনি এর আগেও কয়েকবার মায়ের কাছে চলে এসেছেন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মীমাংসা করে দিয়েছেন। সংসারে ফিরে গেছেন। আবার সেই নির্যাতন। এবার প্রায় পাঁচ মাস আগে স্বামী জেলে যান। আর তমা দুই সন্তানের হাত ধরে মায়ের বাড়িতে চলে আসেন। পণ করেন, তিনি স্বামীর সংসারে ফিরে যাবেন না। তাঁর ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে আর মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদের নগরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে তমার স্বামী তন্ময় পাল স্বীকার করেছেন যে তাঁর নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে। তিনি পেটের দায়ে অন্যের ফেনসিডিল বহন করতেন। নিজে মাদক সেবন করেন না। এখন আর সেই ব্যবসাও করেন না। শুধুই চটপটি বিক্রি করেন। স্ত্রীকে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে তিনি স্ত্রীর নামেই উল্টো অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, স্ত্রী-সন্তানকে আটকে রাখার অভিযোগে তিনি শাশুড়ির নামে আদালতে মামলা করেছেন। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তিনি মেনে নেবেন।

এদিকে মায়ের বাসায় এসে তমা রানী একটি সমিতি থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিমকি তৈরি করে বাজারের পাইকারি দোকানে সরবরাহ শুরু করেন। এর আয় থেকে প্রতিদিন ৭০ টাকা কিস্তি দেন। আর বাকি টাকা দিয়ে কোনো রকমে সন্তানদের নিয়ে খেয়ে পরে দিন কাটান।

এখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তমার নিমকির ব্যবসা বন্ধ। তবে সম্প্রতি আর কিস্তি দিতে হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি পার হলে আবার দিতে হবে। কিন্তু এখন সমস্যা হয়েছে খাওয়া–পরা নিয়ে। তমা রানী পাল রাজশাহী নগরের ভোটার নন। এ জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের তালিকায় তাঁর নাম নেই। তিনি কোনো ত্রাণ পাচ্ছেন না। তাঁর মা সুবাশী রানী দাস সাহায্য পাচ্ছেন। মা তাঁর বরাদ্দ থেকে কিছুটা দিচ্ছেন। এই খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

তমা রানী পাল বলেন, ভেবে পাচ্ছেন না, এভাবে মায়ের খাবার ভাগ করে আর কত দিন কাটাবেন। কীভাবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন?

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই ধরনের সমস্যা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে তাঁদের একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে এলাকার ভোটার নন, এমন ব্যক্তিদেরও ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় করা হবে।