মহাসড়কে খাবারের কষ্ট পণ্য পরিবহনশ্রমিকদের, দাম আকাশছোঁয়া

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দিলেও পুরো দেশ কার্যত লকডাউনে। মানুষ ঘরবন্দী। তবে ঘরবন্দী মানুষের খাবার তো আর বন্ধ থাকবে না। এই খাবারের জোগান আসবে কীভাবে? ঢাকাসহ বড় শহরে তো খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয় না। এ জন্যই সরকার পণ্য পরিবহনের যানবাহনের চলাচল চালু রেখেছে। ঘরবন্দী মানুষের খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত আছেন পণ্য পরিবহনশ্রমিকেরা। তবে পথে পথে হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকার কারণে তাঁদের খাবারদাবারে সমস্যা হচ্ছে।

দেশে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। কিন্তু এর প্রায় সবই বন্ধ। চলছে শুধু কাঁচা সবজি, চালসহ খাদ্যপণ্য এবং জরুরি ওষুধবাহী যান। যা মোট পণ্যবাহী যানের ১০ শতাংশের মতো হতে পারে। কাঁচামাল সরবরাহের একটা বড় উৎস উত্তরবঙ্গ। এর মধ্যে বগুড়া হচ্ছে কেন্দ্র। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকেও কাঁচা সবজি ঢাকাসহ সারা দেশে যায়। একইভাবে চাল, ডাল, পেঁয়াজসহ খাদ্যপণ্যেরও বড় চালান আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের মোকামের মালামালও সারা দেশে যায়। সরকারি চাল পরিবহন তো আছেই। মোটাদাগে এখন পণ্য পরিবহন এগুলোই।

হঠাৎ লকডাউন শুরু হওয়ার পর পরিবহনশ্রমিকেরা মহাসড়কে ব্যাপক খাবারের সংকটে পড়েন। অবশ্য পরে হাইওয়ে পুলিশের সহায়তায় ফেরিঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকেরা জানান, এখন সীমিত হলেও কিছু খাবার পাচ্ছেন। তবে দাম বেশ চড়া।

হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই দফায় মালিক-শ্রমিক সংগঠনের দেওয়া তালিকা ধরে বিভিন্ন স্থানে হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশকেও এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন আর সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, এরপরও আর কোনো নতুন জায়গায় রেস্তোরাঁ খোলা রাখার প্রয়োজন হলে তা তাঁরা করবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে এক-দুজন চালকের চাহিদা মেনে করতে গেলে ঝামেলা। তাই সম্মিলিতভাবে সমিতির মাধ্যমে জানাতে হবে। নতুবা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা জমায়েত বন্ধের যে উদ্যোগ, তা নষ্ট হবে।

পরিবহনচালক ও শ্রমিকেরা বলছেন, পঞ্চগড় বা রাজশাহী থেকে একটি ট্রাক ছেড়ে চট্টগ্রাম যেতে দেড়-দুই দিন সময় লেগে যায়। একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা চালানোর পর ট্রাকের বিশ্রাম দরকার হয়। এ সময়টাতেও তাঁরাও কলা-রুটি কিংবা চা খেয়ে নিজেদের প্রস্তুত করেন। এরপর সুবিধামতো স্থানে এসে ভাত খেয়ে নেন শ্রমিকেরা। এখন পথে চায়ের দোকানও খোলা নেই। খাবারের দোকানও সীমিত।
গত সপ্তাহে বগুড়া থেকে শসা, আলু ও গাজর মিলে প্রায় ১৩ টন কাঁচামাল নিয়ে কুমিল্লার নিমসারে আসেন ট্রাকচালক মো. আশরাফুল। দুই দিনের এই যাত্রায় মাত্র একবার ভাত খেয়েছেন, তা কাঁচপুর সেতুর পাশে। দাম আকাশছোঁয়া, জনপ্রতি ৩০০ টাকায়। সাধারণত উত্তরবঙ্গ থেকে যাত্রা করলে কালিয়াকৈরের শিলাবৃষ্টি পাম্পের পাশে খাবারের বিরতি দেন আশরাফুল। সেখানে সস্তায় ভালো খাবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া পথে পথে চা-পানির বিরতি দেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর খাবারে সংকটই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আশরাফুল জানান, কুমিল্লায় কাঁচামাল নামিয়ে দিয়ে সান্তাহার সাইলোতে চার দিন ধরে বসে আছেন। এখান থেকে সরকারি চাল পরিবহন করে ঢাকার তেজগাঁওয়ে নিয়ে যাবেন। সেখানেও খাবারদাবারের দারুণ কষ্ট।

পরিবহনশ্রমিকেরা জানান, একটি পণ্যবাহী ট্রাকে চালকের সঙ্গে কমপক্ষে একজন সহকারী থাকেন। চালকের কখনো কখনো নামমাত্র বেতন থাকে। মূল আয় ভাড়ার কমিশনের ওপর। যত আয় হয়, এর শতকরা ২০ শতাংশ শ্রমিকেরা পান। কিন্তু লকডাউনের কারণে অধিকাংশ পরিবহনশ্রমিক যাঁর যাঁর গ্রামে চলে গেছেন। ট্রিপ পেলে পেটের টানে কেউ কেউ আসেন। খাবারের কষ্ট এবং ট্রিপের স্বল্পতার কারণে সপ্তাহে দুই ট্রিপ দিতেই পারলেই খুশি।

জয়পুরহাট থেকে গত সপ্তাহে আলু নিয়ে কুমিল্লার চান্দিনায় গিয়েছিলেন উজ্জ্বল শেখ। তিনি বলেন, রাস্তা ফাঁকা। ফলে চাইলে টেনে চলে আসা যায়। কিন্তু মালবাহী ট্রাক নির্দিষ্ট গতির বেশি গতিতে চালানো যায় না। এ ছাড়া গাড়িকে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিশ্রাম দিতে হয়। স্বাভাবিক সময়ে এই বিরতিতে তাঁরা চা-নাশতা খেতেন। ভাত খাওয়ার জন্যও নির্ধারিত জায়গা আছে। চট্টগ্রামে গেলে চৌদ্দগ্রাম ও ফেনীর মাঝামাঝি মহাসড়কে বেশ কয়েকটি হোটেল আছে শুধু পরিবহনশ্রমিকদের জন্য। সেখানে তাঁরা ভাত খেতেন। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর আগের ছক বদলে গেছে।

বগুড়া ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে বগুড়া থেকে দিনে ৯০০ থেকে এক হাজার ট্রাক চলাচল করত। এখন শ–দুয়েক ট্রাক চলাচল করে। সবই কাঁচামাল ও চাল পরিবহন করে থাকে। তিনি জানান, তাঁরা বগুড়ায় ১০০ শ্রমিকের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। মূল সমস্যা আসলে পথে পথে। তিনি জানান, এই দুর্যোগের সময় জেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জায়গাতে মালামাল ওঠা-নামা বা ট্রাক রাখার জন্য টোল দিতে হচ্ছে। বছরব্যাপী ইজারা নেওয়ার কারণে ইজারাদার এই দুর্যোগেও ছাড় দিচ্ছে না। এটা এখন বন্ধ হওয়া উচিত।

তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল থেকে বেশি চলে কাভার্ড ভ্যান। তৈরি পোশাক খাতের মালামাল, অন্যান্য শিল্পপণ্য ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহন হয় বেশি। লকডাউনের কারণে শ্রমিকেরা এখন বেকার। কিছু কাঁচামাল ও সরকারি খাদ্যপণ্য পরিবহনের ট্রাকও আছে। ফলে টার্মিনালে প্রতিদিনই কিছু চালক-শ্রমিকের জটলা–উপস্থিতি থাকছে। এ জন্য মালিক-শ্রমিকেরা মিলে কিছুদিন ধরে দুপুরে তিন-চার ডেকচি খাবার রান্না করেন তেজগাঁও টার্মিনালে। কোনো দিন ভাত-শবজি, কোনো দিন খিচুড়ি রান্না হয়। গতকাল শুক্রবার দুপুরে খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছেন চালকেরা।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, টার্মিনালে তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। মহাসড়কে শ্রমিকেরা যাতে খাবারের কষ্টে না পড়েন, সে জন্য হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে তাঁরা কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, পণ্য পরিবহনব্যবস্থা যেকোনো মূল্যে চালু রাখতে হবে। নতুবা দেশে খাদ্যসংকট তৈরি হবে। এ জন্য সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা তৎপর আছেন।