করোনা প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করছে। কেউ কেউ টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক মাত্রায় পর্যবেক্ষণ করছে। কেউ মুঠোফোন অ্যাপ দিয়ে মানুষকে করোনা রোগীর কাছাকাছি যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করছে। কেউ ড্রোনে থার্মাল স্ক্যানার বসিয়ে চলাচলরত মানুষের জ্বর মাপছে। বিভিন্ন দেশে খাবার ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে ড্রোন অথবা রোবট। মানুষ মুখে মাস্ক পরছে কি না, তা–ও তদারকি করা হচ্ছে ড্রোন দিয়ে।

করোনা প্রতিরোধযুদ্ধে বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, তবে তা সীমিত পর্যায়ে। বিগ ডেটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বাংলাদেশেও ডিজিটাল ম্যাপিং করা হচ্ছে, তবে মাঠপর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। একটি অ্যাপ তৈরি হয়েছে, যার কোনো প্রচার নেই। জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন ও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হচ্ছে, তবে তা–ও সীমিত পর্যায়ে।


চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় এআইভিত্তিক ডায়াগনসিস সেবা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে, যদিও ব্যবহার শুরু হয়নি। মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা সাধারণ মানুষের জন্য একটি সেবা চালু করতে চেয়েছিল, যেখানে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ বা করোনা আক্রান্ত অথবা উপসর্গধারী কারও কাছে গেলে মুঠোফোনে সতর্কতার বার্তা পাওয়া যেত। অবশ্য সেবাটি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়।

জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু উদাহরণ দেন। এর মধ্যে রয়েছে করোনা নিয়ে ওয়েবসাইট, করোনা প্রাথমিক পরীক্ষার ওয়েবসাইট ও হেল্প লাইন চালু, শিক্ষার্থীদের সংসদ টেলিভিশন ও অনলাইনে পড়াশোনা, ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ, করোনার পরিস্থিতি নিয়ে ম্যাপিং করার উদ্যোগ ইত্যাদি। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, লাইভকরোনাটেস্টডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে করোনার প্রাথমিক পরীক্ষা করিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ। মোবাইল অপারেটর ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৬ লাখের বেশি মানুষের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।

জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেন, করোনা সংক্রমণের এ সময়ে আইসিটির ব্যবহার আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

অবশ্য অন্যান্য দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দেখলে বাংলাদেশের ব্যবহার সীমিত মনে হবে। যদিও বাংলাদেশের কাছে অনেক প্রযুক্তিই ছিল।

দেশে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি
চীনের কিছু শহরে এখন পাতাল রেলে চলাচল করতে নাগরিকদের তাঁদের স্মার্টফোন দেখাতে হয়। কেউ ট্রেনে উঠতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করে ফোনের পর্দায় থাকা সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের সংকেতের ওপর। সবুজ মানে হলো, ওই ব্যক্তির করোনাভাইরাস সংক্রমণ নেই। কোনো লক্ষণও ছিল না। হলুদ মানে হলো, ব্যক্তিটি কোনো আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন, কোয়ারেন্টিন শেষ করেননি। লাল আরও বিপজ্জনক, করোনায় আক্রান্ত অথবা কোনো লক্ষণ ছিল।

দেশের বিকাশ-রকেটের মতো মুঠোফোনভিত্তিক আর্থিক সেবার (এমএফএস) চীনা অ্যাপ আলি পে ডাউনলোড করে তাতে একটি ফরম পূরণ করলে নাগরিকেরা জানতে পারেন তাঁদের সংকেত কোনটি—সবুজ, হলুদ, না লাল। চীনা সরকার পুরো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা দিয়ে নানাভাবে সংগৃহীত বিপুল তথ্য বা বিগ ডেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে লাল-সবুজ নির্ধারণ করে।
যদিও এতে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু করোনাভাইরাসজনিত লকডাউন তুলে নেওয়ার পর সংক্রমণ রোধ করতে এই ব্যবস্থা কাজে দিচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ড্রোনে থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করে জ্বর থাকা মানুষ শনাক্ত করা, রোবট দিয়ে জীবাণুনাশক ছিটানো, খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পুলিশ বিশেষ ধরনের হেলমেট ব্যবহার করছে, যা জ্বর আক্রান্ত কেউ আশপাশে এলে শনাক্ত করে।

দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রত্যেক বিদেশফেরত নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে। এ ছাড়া কোরীয় সরকার মোবাইল কোম্পানির তথ্য, ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করে কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্তের কাছাকাছি গিয়েছিলেন কি না, তা শনাক্ত করেছে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ১৮ মার্চের এক প্রতিবেদনে এশিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহারের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে সরকার বিগ ডেটা ব‌্যবহার করে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করেছে। সেখানে রোবট মানুষের বাসায় খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দেয়। ভিয়েতনাম দেশীয় ও বিদেশি নাগরিকদের মোবাইল অ্যাপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ বা ট্র্যাক করছে। থাইল্যান্ডও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপকমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করছে।

পাশের দেশ ভারত আরোগ্য সেতু নামের একটি অ্যাপ চালু করেছে। নানা সুবিধার মধ্যে এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্যবহারকারীর আশপাশে কোনো করোনা রোগী আছে কি না, তা জানিয়ে দেয়। আবার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করার বিষয়েও ব্যবহারকারীকে সতর্ক করে এই অ্যাপ। চালুর ১৩ দিনে এটি ৫ কোটির বেশি ডাউনলোড হয়েছে।

বিগ ডেটা ও এআই দেশেই
বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বর বা অন্য কোনো উপসর্গ দেখা গেলে সাধারণ মানুষকে ১৬২৬৩ ও ৩৩৩ নম্বরে ফোন করতে বলছে সরকার। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) হটলাইন নম্বরেও ফোন আসছে।

বিভিন্ন নম্বরে আসা কলগুলো বিশ্লেষণ করে সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন গত ২ এপ্রিল অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের পলিসি অ্যাডভাইজার অনীর চৌধুরী জানিয়েছিলেন, আগের ১০ দিনে করোনার বিষয়ে জানাতে ৩ লাখ ৭০ হাজার ইউনিক কল আসে।

করোনা নিয়ে একটি ডিজিটাল ম্যাপ তৈরির জন্য সরকার এ উদ্যোগ নেয়। এর সঙ্গে সরকারের এটুআই প্রকল্প, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মোবাইল অপারেটরদের সংযুক্ত করা হয়।

রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, করোনা ভাইরাসজনিত মহামারি মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করার জন্য এটুআই ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টায় রবি একটি শক্তিশালী ডেটা অ্যানালিটিকস সিস্টেম গঠন করেছে। এর মাধ্যমে বিপুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে, যা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগছে।

গ্রাহক পর্যায়ে অ্যালার্ট সার্ভিস বা সতর্ক করার সেবার অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী অপারেটরেরা। রবির সাহেদ আলম বলেন, ‘শিগগিরই ডেটা অ্যানালিটিকস সল্যুশনের মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্যবহার উপযোগী বেশ কিছু সেবা আমরা যুক্ত করবে। এটা নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি, আশা করা যায় এ সেবাগুলো করোনা প্রতিরোধে গ্রাহকদের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন নম্বরে (১৬২৬৩) এখন দিনে ৭০ হাজারের বেশি কল আসে।
স্বাস্থ্য বাতায়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব কল যাঁরা করেন আমরা তাঁদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রাখি। সেখান থেকে প্রতিদিন একটা পরিস্থিতি প্রতিবেদন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। এখন দেখা যাচ্ছে ৩৫টি জেলা থেকে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর কল বেশি আসছে।’

নিজাম উদ্দিন আহমেদ আরও জানান, স্বাস্থ্য বাতায়ন একটি অ্যাপ তৈরি করছে, যেখানে চিকিৎসকেরা স্বপ্রণোদিত নিবন্ধন করবেন। রোগীরা ওই অ্যাপ ব্যবহার করে পছন্দের চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারবেন। এটি শিগগিরই চালু হবে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ফোনে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এখন কী করা যায়
বিভিন্ন দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে যখন বিদেশ থেকে মানুষ আসতে শুরু করে, তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা যেত টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কোরিয়া এ কাজটিই করেছে। দেশটির প্রত্যেক বিদেশফেরত নাগরিককে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে মুঠোফোনে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়েছে। যেখানে পরবর্তী ১৪ দিনে তাঁদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি জানাতে হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদেশফেরতদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেল অনেক যাত্রীর তথ্যই কাগজে রয়ে গেছে। ডিজিটাল তথ্যভান্ডার তৈরি হয়নি। পরে শুধু পাসপোর্টে থাকা মুঠোফোন নম্বরের ভিত্তিতে কোন এলাকায় বিদেশফেরত বেশি, তার একটা ম্যাপিং করা হয়।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির তিন মিটারের মধ্যে কতজন এসেছেন, সেটা বের করার প্রযুক্তি দেশেই আছে। এভাবে খুঁজে বের করে পরীক্ষা করলে করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অবশ্য এ জন্য বিপুলসংখ্যক নমুনা সংগ্রহকারী ও পরীক্ষার কিট দরকার। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের কার্ড ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবার মাধ্যমে করা যায়। শ্রমিকদের মজুরিও দেওয়া যায় বিকাশ-রকেট, নগদের মতো সেবার মাধ্যমে।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ কতটুকু জানতে চাইলে আঞ্চলিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা সংস্থা লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশফেরতদের নজরদারিতে রাখার প্রথম সুযোগটি আমরা হারিয়েছি। তাঁদের শুধু একটি করে মুঠোফোনের সিম দিয়ে সেটা চালু রাখার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা গেলেই নজরদারিতে রাখা যেত। তিনি বলেন, দেশের সব ওষুধের দোকানের তালিকা সরকারের কাছে আছে। এখন গুগল ম্যাপে সেটা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এরপর সেখানে কারা যাচ্ছে, হাসপাতালে কারা যাচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নম্বরে কারা ফোন করছে এ সবকিছু মিলিয়ে একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে।

আবু সাঈদ খান বলেন, শুধু করোনা নিয়ে নয়, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে একটি ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেটা হবে সরকারের বড় সম্পদ। এটার মালিকানা ও নিরাপত্তা পুরোপরি সরকারের হাতে থাকতে হবে।

অবশ্য সমস্যা হলো দেশে ব্যবস্থাপনার বড় অভাব। করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর বিদেশ থেকে যখন মানুষ আসছিল, তখন দেখা গেল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তিনটি থার্মাল স্ক্যানারের দুটিই নষ্ট।