অলিগলির কুকুর-বিড়ালদের খাওয়ান তাঁরা

রাস্তার পশুদের জন্য রান্না করা খাবার। ছবি: সংগৃহীত
রাস্তার পশুদের জন্য রান্না করা খাবার। ছবি: সংগৃহীত

দিন বা রাতের কোনো একটি সময়ে তাঁদের দেখা যায় বালতি ভর্তি রান্না করা খাবার নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। বালতিতে কখনো কখনো মাংস ডিম দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি। কোনো দিন ভাত-মাংস একসঙ্গে। যাদের জন্য এই আয়োজন, তারা জড়ো হওয়া মাত্র কাগজে বা রাস্তার স্ল্যাবে খাবার ঢেলে দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে অলিগলির কুকুর, বিড়ালের। পথের এই সব পশুদের জন্য এই সময়ে নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কিছু মানুষ। কেউ গ্রুপ ধরে, কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই খাবার বিতরণ করছেন।

পশুপ্রেমী এই মানুষদের বক্তব্য হচ্ছে, জীব মাত্রই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। আপনি-আমি সবাই কিছু দায়িত্ব ভাগ করে নিলে সংকট মোকাবিলা করা কিছুটা সহজ হতে পারে।

কথা হলো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পশুদের খাবার দেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে।

কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন এক নারী। ছবি: সংগৃহীত
কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন এক নারী। ছবি: সংগৃহীত

ডি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা ব্যবসায়ী দম্পতি আমরিন হক এবং জোবায়ের আহমেদ ২০ দিন ধরে দিনে ২৫ থেকে ৩০টি কুকুরকে খাবার দিচ্ছেন। আমরিন হক জানান, তিনি ছোটবেলা থেকে পশুপ্রেমী। এখনো তাঁর বাসায় আটটি বিড়াল আছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর বাড়িওয়ালা সংক্রমণের ভয়ে বিড়াল সরাতে বলেন বাসা থেকে। তিনি সেগুলোকে বি ব্লকে মায়ের বাসায় দিয়ে আসতে গেলে দেখতে পান রাস্তায় কতগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে।

আমরিন বলেন, ‘কুকুরগুলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেগুলো ক্ষুধার্ত। এলাকার দোকানপাট, রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। ফলে উচ্ছিষ্ট খাবারও জুটছিল না পশুগুলোর। ওই দিনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি খাওয়াব।’

আমরিন জানান, তিনি ডি ব্লকের চারটি রোড এবং বি ব্লক পর্যন্ত সেসব কুকুর, বিড়াল পান, সেগুলোকে দিন বা রাতে যেকোনো একবেলা খাবার দেন। প্রতিদিন আড়াই কেজি চালের সঙ্গে পাঁচ-ছয়টা ডিম ও এক থেকে দেড় কেজি মাংস মিশিয়ে রান্না করেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনে বালতিতে করে খাবার নিয়ে বের হয়ে যান।

কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন বসুন্ধরা ওয়াচম্যান গ্রুপের সদস্য। ছবি: সংগৃহীত
কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন বসুন্ধরা ওয়াচম্যান গ্রুপের সদস্য। ছবি: সংগৃহীত

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নাহিয়ান নওশীন নূর, অঙ্কিতা চৈতী, কাজী ফাহমিদ, আরেশ আরয়ানি, দেওয়ান আল ফাহাদ, শর্মী হকসহ ১৮ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে ‘বসুন্ধরা ওয়াচম্যান’ নামে।

এই গ্রুপের সদস্যরা পালা করে একেকবার একেকজনের বাসায় রান্না করছেন রাস্তার কুকুর, বিড়ালের জন্য। যিনি যখন ফ্রি থাকেন, তিনি তখন খাবার বিতরণ করেন। নিজেদের মধ্যেই টাকা তুলে তহবিল করেছেন। তবে বিদেশে রয়েছেন এমন পরিচিত কয়েকজন তাঁদের অর্থ দান করেন।

এই গ্রুপের একজন নাহিয়ান নওশীন নূর এ ব্লকের বাসিন্দা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স পাশের পর এখন ইনসাইডম্যাপস নামের প্রতিষ্ঠানে ক্লায়েন্ট রিলেশন্স স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্মরত। নওশীন জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরুর পর প্রতিদিন ২০০ কুকুরকে তাঁরা একবেলা করে খাওয়ান। গত সপ্তাহে তহবিল থেকে ছয় বস্তা চাল কিনেছেন। একেক বস্তায় ৫০ কেজি চাল। আর বেঙ্গল মিটের বিক্রির পর উচ্ছিষ্ট থেকে যাওয়া মাংস, হাড় তাঁরা কম মূল্যে কিনে নেন। প্রতিদিন ১৫ কেজি করে চাল রান্না করেন। রান্নার দায়িত্বটা চার-পাঁচজন মিলে ভাগ করে নেন। রান্না শেষে যাঁরা ফ্রি থাকেন, তাঁরা বাসাগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করে রাস্তায় বিতরণ করেন।

কাজটি করতে গিয়ে নানান চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হয় বলে জানালেন নওশীন ও আমরিন। আমরিন বলেন, ‘যেখানেই খাবার দিতে যাই, আশপাশ থেকে দারোয়ানেরা রাগারাগি করেন, জায়গা নোংরা হবেন বলেন। আমরা সঙ্গে করে নিউজ পেপার নিয়ে যাই। সেগুলোর ওপর খাবার দিই। খাবার শেষ হলে জায়গা পরিষ্কার করে দিই।’

কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন বসুন্ধরা ওয়াচম্যান গ্রুপের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন বসুন্ধরা ওয়াচম্যান গ্রুপের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

নওশীন বলেন, ‘অনেক বাড়ির দারোয়ানেরা মারমুখী আচরণ করেন। এ ছাড়া কাজটি করতে গিয়ে আমাদের একটি কথা প্রায়ই শুনতে হয়—“মানুষই খাবার পায় না, তো পশু”, “এসব খাবার মানুষকে দিলেই তো হয়”। কিন্তু আপনারা পশুদের অসহায়ত্বের কথা একবার ভেবে দেখুন। মানুষ চেয়ে খেতে পারে, ওরা পারে না। এ ছাড়া রাস্তার পশুরা অভুক্ত থেকে থেকে হিংস্রও হয়ে উঠতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দরিদ্র মানুষদেরও সাহায্য করছি। তবে আমাদের কাজের অগ্রাধিকারের জায়গা পাচ্ছে মালিকবিহীন পশুরা।’

এলাকার সি ব্লকের চার নম্বর রোডের একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী মনির জানান, এলাকায় বেশ কয়েকজন কুকুর, বিড়ালগুলোকে খাবার দেন। তিনি যেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী, সেই বাসারও একটি পরিবার কুকুরগুলোকে খাওয়ানোর জন্য ভাত দিয়ে থাকে। তিনি প্রতিদিন দুপুরবেলা পলিথিনে ভরে সেই ভাত রাস্তায় রেখে আসেন। তাঁকে দেখলেই কুকুরগুলো ছুটে আসে।

করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার এই পরিস্থিতির মধ্যে পশুপ্রেমী কয়েকজনের উদ্যোগ মনে করিয়ে দেয় স্বামী বিবেকানন্দের ‘সখার প্রতি’ কবিতার বহুল পঠিত দুটি লাইন—বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।