নারায়ণগঞ্জে করোনা রোগী নিয়ে হিমশিম

করোনাভাইরাস বা কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। রাজধানী ঢাকার পরেই সবচেয়ে বেশি রোগী এই জেলায়। গতকাল পর্যন্ত এই জেলায় মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৩৮৬। মারা গেছেন ৩০ জন। আর এই জেলায় এখন পর্যন্ত করোনা রোগীদের চিকিৎ​সার জন্য শয্যা আছে মাত্র ৮০টি। কিন্তু প্রতিদিন যেভাবে রোগী বাড়ছে, শিগগির আরও হাসপাতাল বা চিকিৎ​সার জন্য শয্যা না বাড়ালে বিপাকে পড়তে হবে। এ আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারাও।

রাজধানীর নিকটবর্তী এই জেলাকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডি​সিআর) ইতিমধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রস্থল হিসেবে ​চিহ্নিত করেছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে যে ৩১২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৩১ শতাংশই নারায়ণগঞ্জের এবং মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন এই জেলার। জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ সাত চিকিৎসক কোভিড–১৯ আক্রান্ত। ৮ এপ্রিল এই জেলাকে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে।

আই​ইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ বড় উদ্বেগের জায়গা। এখানে প্রচুর আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। নারায়ণগঞ্জে কারও মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে তাঁকে চিকিৎ​সার আওতায় আনতে হবে। আইসোলেশনে নিতে হবে। তিনি বলেন, এখন নারারণগঞ্জের জন্য রোগ শনাক্ত পরীক্ষার চেয়ে রোগী ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ​।

পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন রকম শিল্পকারখানার কারণে নানা জেলার শ্রমিক–কর্মচারী নারায়ণগঞ্জে বাস করেন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত এই জেলার জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ২৯ লাখ। তবে স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে এখন জনসংখ্যা ৫০ লাখের বেশি হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে এখানে এমনিতে চিকিৎ​সাব্যবস্থা খুব অপ্রতুল। এখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এখানকার দুটি হাসপাতালকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎ​সার জন্য নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে শহরের খানপুরে অবিস্থত নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে (সরকারি) করোনা রোগীদের জন্য ৫০টি শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি শয্যা হলো আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র)। অবশ্য আইসিইউ, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ও ভেন্টিলেটর স্থাপনের কাজ এখনো চলছে।

>

নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত হওয়া মোট রোগী ৩৮৬ জন। মারা গেছেন ৩০ জন। চিকিৎসার শয্যা আছে মাত্র ৮০টি।

তবে এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কসহ ৩ জন চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ ১৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা আইসোলেশনে আছেন।

টেলিফোনে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গৌতম রায় প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ চালু করতে তাঁদের ১৫ থেকে ২০ দিন লাগতে পারে। তিনি জানান, তাঁদের হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে এখন তিন নারীসহ ১২ জন ভর্তি আছেন। গতকাল জরুরি বিভাগে রোগী দেখা হয়েছে ২৩ জন।

করোনার চিকিৎ​সার জন্য নির্ধারিত অপর হাসপাতালটি হলো সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে অবস্থিত সাজেদা হাসপাতাল। বেসরকারি এই হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য চারটি আইসিইউসহ ৩০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট রয়েছে। সেখানে এখন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন ২৮ জন এবং আইসিইউতে আছেন ২ জন। তাঁদের মধ্যে এক শিশুসহ ১০ নারী রয়েছেন।

সাজেদা আইসোলেশন হাসপাতালের পরিচালক তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসকসহ তাঁদের পর্যাপ্ত জনবল রয়েছে। তাঁদের চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো সংকট নেই।’

তবে আক্রান্ত রোগীর তুলনায় এই জেলায় চিকিৎ​সা–সুবিধা খুবই সীমিত। শনাক্ত হওয়া রোগীদের বেশির ভাগকে বাড়িতে থেকে চিকিৎ​সা নিতে বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অনেক রোগী আছেন, যাঁদের বাড়িতে একটি মাত্র কক্ষ। তাঁর পক্ষে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা সম্ভব নয়। ওই রোগীগুলোকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা জরুরি। এ ছাড়া জরুরি রোগীদের বাড়িতে আইসোলেশনে রাখা সম্ভব নয়। তাই নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত আইসোলেশন সেন্টার ও হাসপাতালের শয্যা বাড়ানোর প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন যাঁদের অন্য শারীরিক সমস্যা বা জটিল রোগ রয়েছে, কেবল তাঁদেরই হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। অবস্থা খারাপ হলে অনেক রোগী রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। খুব বেশি সংকটাপন্ন রোগী না হলে সেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়াও কঠিন বলে অনেক রোগীর স্বজনেরা জানিয়েছেন। আবার করোনা আক্রান্ত রোগীদের রাজধানী পর্যন্ত আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাওয়াও কঠিন কাজ।

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘করোনা চিকিৎসার জন্য আইসোলেশনে হাসপাতাল ও শয্যা বাড়াতে হবে। এখানে রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে হাসপাতালে শয্যা না বাড়ালে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বিপদে পড়ে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সের কোনো সংকট নেই। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) আছে। এন-৯৫ মাস্ক নেই। তবে কেএন-৯৫ মাস্ক রয়েছে। সেগুলো দিয়ে কাজ চালাতে সমস্যা হবে না।’

এদিকে জেলায় করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকেই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন রোগীর স্বজনেরা। ভর্তি করানোর পর চিকিৎসাসেবাও ভালোভাবে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যবসায়ী আবু সাঈদের ছেলে মেহেদী হাসান। একই রকম অভিযোগ করেছেন সর্বশেষ মারা যাওয়া সিপিবি নেতা বিকাশ সাহার ছেলে অনির্বাণ সাহা।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে বাড়লেও এই জেলায় সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেই। যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে শয্যা বাড়ানো না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তাই জেলায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আপাতত ৪০০ থেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত করা জরুরি।

এ বিষয়ে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলায় জনসংখ্যাও বেশি, রোগীও বেশি। তাই সবকিছু সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘দুটি হাসপাতালে (৮০ শয্যা) করোনা চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরও দুটি হাসপাতাল সাইনবোর্ড এলাকার প্রো-অ্যাকটিভ মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ও মদনপুরে আল–বারাকা হাসপাতালের সাথে কথা হচ্ছে। ওই দুটি হাসপাতাল হলে আইসোলেশনে আরও প্রায় ৩০০ রোগী ভর্তি করা যাবে।’