ফোন পেয়েই খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছোটেন নাফিসা

সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায় খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেট নিয়ে ছুটছেন নাফিসা আনজুম খান। করোনাভাইরাসের বিস্তারে যে মানুষগুলোর ঘরে খাবার নেই, তাঁদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এসব সামগ্রী। আর এই মানুষগুলো, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত যাঁরা লজ্জায় সবার কাছে ত্রাণ চাইতে পারেন না, তাঁরা নাফিসাকে ফোন দেন সহায়তার জন্য। নাফিসা খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার পর ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছেন না। ফলে কারও পরিচয় প্রকাশের সুযোগ নেই। তাই তো নাফিসার ভাষায়, এই উপহার পাওয়া পরিবারগুলো তাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

প্রথম দিকে সাহায্যপ্রার্থীরা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নাফিসার বাসায় এসে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। তবে দেড় সপ্তাহ ধরে নাফিসা নিজেই তা পৌঁছে দিচ্ছেন। কখনো নির্ধারিত ঠিকানায় আবার কখনো হাতে হাতে।

করোনাভাইরাসের বিস্তারের সময়ও নাফিসা ঘরে বসে নেই। বাজার করা, প্যাকেট করা, যে বন্ধু বা স্বজনেরা চাল–ডালসহ বিভিন্ন পণ্য দিচ্ছেন, তা সংগ্রহ করাসহ পুরো কাজটিই করছেন নাফিসা। তবে তাঁর এই কাজে সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছেন নাফিসার বাবার বাসার ভাড়াটে প্রতিবেশী সিএনজিচালক, গৃহিণী, ছাত্রসহ নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা নাফিসার মুঠোফোনে আসা কল রিসিভ করেন, খুদে বার্তা পড়ে কাদের সাহায্য বেশি প্রয়োজন বা কোন এলাকার কতজন তার হিসাব রাখেন।

আর নাফিসার এই কর্মযজ্ঞে নাফিসার নিজের বেতন ও পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও গ্রামীণফোন কোম্পানির সাবেক সহকর্মী, বর্তমান কর্মস্থল সিনি কেয়ার বাংলাদেশ নামক একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির সহকর্মীসহ বন্ধু–স্বজন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু নাফিসার ভয় করোনায় সাহায্যপ্রার্থী পরিবারের কাছ থেকে প্রতিদিনই ফোনের সংখ্যা বাড়ছে। ফোনে যে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, তারা সবাই নাফিসার অপেক্ষায় বসে আছে। সবার জন্য যদি খাবার দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে? বাসায় পৌঁছে দেওয়া প্রতিটি প্যাকেটে থাকে চাল, ডাল, তেল, আলু, স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি পরিবারের কাছে নাফিসা খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন।

ফোনে যাঁরা সহায়তা চেয়েছেন, তাঁদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন নাফিসা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
ফোনে যাঁরা সহায়তা চেয়েছেন, তাঁদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন নাফিসা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নাফিসা তাঁর মুঠোফোনের নম্বরটি দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি যে অটোরিকশায় বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন, তাতেও নম্বরটি বড় করে লেখা আছে। ‘বিনা মূল্যে খাবার সরবরাহ, পরিচালনায় নাফিসা আনজুম খান, একজন বাংলাদেশ’—এ কথাগুলোও বড় করে লেখা। হাসতে হাসতে নাফিসা বললেন, ‘অনেকে আমার নম্বরটিকে হটলাইনের নম্বর ভাবে। আবার অনেকে ভাবে সিটি করপোরেশনের নম্বর। ফোন ধরতে না পারলেই লিখে পাঠান ফোনে পাচ্ছেন না। অনেকে ফোনে নানা খুদে বার্তা পাঠিয়ে বিরক্তও করে। তবে এসব নিয়ে ভাবি না।’

নাফিসা বললেন, তিনি সরাসরি কারও কাছ থেকে টাকাপয়সা সহায়তা নিচ্ছেন না। অনেক সহায়তা করছেন। নাফিসার মতে, শুধু টাকা পয়সা দিয়েই নয়, সাহায্য করার মনোভাব থাকলে বিভিন্নভাবে তা করা যায়। সোমবার ফেসবুকে নাফিসা লিখেছেন, ‘আগামী সপ্তাহ থেকে ১০০০ মানুষের জন্য উপহার পৌঁছে দিতে তৈরি হচ্ছি আমি। আপনাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন, যেন প্রতিদিন আমার কাছে আসা শত শত ফোন কল/মেসেজের ওপারের মানুষগুলোর কাছে খাবার পৌঁছে দিতে পারি। আপনার ঘরে যা আছে, তা–ই দিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। চাল/ডাল/আটা/আলু/পেঁয়াজ/তেল/লবণ নিতে আমি চলে আসব আপনার দরজায়। কারও সুযোগ থাকলে আমাকে কমেন্ট করে জানাবেন প্লিজ। ধন্যবাদ।’

পথশিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাজধানীর আদাবর ও কামরাঙ্গীরচরে দুটি স্কুল পরিচালনা করেন নাফিসা। করোনাভাইরাসের বিস্তারে তাঁর স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নিজের জন্মদিন ২৭ মার্চ কিছুটা ভিন্ন ধরনের কাজ করার জন্যই তাঁর স্কুলের শিশুদের পরিবারের খবর নেন। তাতে দেখেন এই পরিবারের সদস্যদের প্রায় সবারই কাজ বন্ধ, ঘরে খাবার নেই। জন্মদিন পালনের জন্য যে টাকা ছিল, তা দিয়েই শিক্ষার্থীসহ ৮০০ পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দেন। বর্তমান কর্মস্থল থেকে আগাম তিন মাসের বেতন হাতে থাকায় এ কাজে আর ইস্তফা দেননি।

নাফিসা বললেন, অনেকে সুযোগও নেয়। সাহায্য পেতে একই বাসার চার সদস্য একই এলাকার চার ঠিকানা দিয়ে খুদে বার্তা পাঠান। নাফিসা বললেন, একই এলাকার বেশ কয়েকজন হলে ওই এলাকার নির্দিষ্ট একটি জায়গায় আসতে বলা হয় সবাইকে। যখন আসেন, তখন অনেকের হাবভাব দেখেই বোঝা যায় তারা একই পরিবারের সদস্য। তাই এখন খুদে বার্তাগুলো ভালো করে যাচাই করে খাবার দেওয়া হবে।

ফোনে যাঁরা সহায়তা চেয়েছেন, তাঁদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন নাফিসা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
ফোনে যাঁরা সহায়তা চেয়েছেন, তাঁদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন নাফিসা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

নাফিসা একাই কাজটি শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর কাজ দেখে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউল্যাবের ইউল্যাব অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এগিয়ে আসে। নাফিসা জানান অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া টাকায় ৫০ পরিবারকে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল ১০ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি পেঁয়াজ, ২ কেজি আটা, সাবান, গুঁড়ো দুধ, তেল ও লবণ। নাফিসা ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন।

নাফিসা জানান, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত নাফিসার মুঠোফোনে আসা কলগুলো রিসিভ করা হয়। তবে নিজের খাওয়াসহ বিভিন্ন কাজের জন্য বিরতিও থাকে। নাফিসা জানান, পথে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও জানতে চান তিনি কী কাজ করছেন। সব শোনার পর ওই সদস্যরাই সার্বিক সহায়তা করছেন। নাফিসা পুলিশসহ পথের এই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

নিজের সুরক্ষার বিষয়ে কতটুকু সচেতন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাফিসা বলেন, মুখে মাস্ক ব্যবহার করেন। পাতলা একটি অ্যাপ্রোন গায়ে দেন। উপহারসামগ্রী বিতরণের সময় সিএনজিতেই থাকার চেষ্টা করেন এবং সাহায্য প্রার্থীদের সামাজিক দূরত্ব মেনে প্যাকেটগুলো নিতে বলেন। কেউ কেউ তা মানেন, আবার অনেকেই তা মানতে চান না। তবে প্যাকেট হাতে নিয়ে মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখার পর করোনার কথা আর মনে থাকে না বলে জানালেন নাফিসা।