৭৯ শতাংশ করোনা রোগীর চিকিৎসা ফোনে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৭৯ শতাংশ বাড়ি থেকে টেলিফোনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁরা ওষুধ, খাবার ও পরিচর্যার বিষয়গুলো জেনে নিচ্ছেন। অবস্থা জটিল হলে কোন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায়, তা–ও জেনে নিচ্ছেন রোগী বা তাঁদের স্বজনেরা।

টেলিমিডিসিন সেবা যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়িতে থেকে রোগীরা জানতে চান, পরিস্থিতি খারাপ হলে তাঁরা কী করবেন, অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করবেন কীভাবে, বিশেষায়িত সেবা পাবেন কোথায়।

কে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন, আর কে হাসপাতালে ভর্তি হবেন, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে একজন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, তার একটি নির্দেশনা আছে কোভিড–১৯ চিকিৎসাবিধিতে (ট্রিটমেন্ট প্রটোকল)। কিন্তু তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না বলে কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

১৯ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই ব্যক্তির উপসর্গ ছিল মৃদু। আইইডিসিআর তাঁকে বাড়িতেই থাকতে বলে। কিন্তু রাতে এই ব্যক্তির কিছুটা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের একজন অধ্যাপক টেলিফোনে ব্যবস্থাপত্র দেন। তাতে এক্স–রে এবং রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ ছিল। রাতে তা করানো সম্ভব হয়নি। পরিবারের সদস্যরা বেশ কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। রোগীকে কোভিড–১৯–এর জন্য সরকারনির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা চলে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি নেয়নি। পরদিন সকালে তিনি অন্য হাসপাতালে ভর্তি হন।

দেশে গতকাল শনিবার পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৯৮ জন। তাঁদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি গেছেন ১১২ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৪০ জনের। গতকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪ হাজার ৭৪৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) আমিরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল পর্যন্ত রাজধানীর নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোয় এবং বিভিন্ন জেলায় সর্বোচ্চ এক হাজার রোগী ভর্তি ছিলেন।

সেই হিসাবে হাসপাতালের বাইরে বা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩ হাজার ৭৪৬ জন। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ রোগী হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এটা তাঁদের অধিকার।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িতে থাকা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোগীর কার্যকর চিকিৎসা ও ফলোআপ আরও ফলপ্রসূ করার পন্থা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।’

কে হাসপাতালে ভর্তি হবেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করোনা রোগীদের চারটি ভাগে ভাগ করেছে। তারা বলছে, ৪০ শতাংশ রোগীর উপসর্গ থাকে মৃদু। ৪০ শতাংশের উপসর্গ মাঝারি, তাঁদের নিউমোনিয়া থাকে বা থাকতে পারে। ১৫ শতাংশের পরিস্থিতি থাকে মারাত্মক। বাকি ৫ শতাংশের জটিল উপসর্গ দেখা দেয়।

কোভিড–১৯ রোগীর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশনায় রোগীদের চারটি ভাগ করা হয়েছে। শুরুতে আছে মৃদু উপসর্গের রোগী, যাঁদের ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো দুর্বলতা থাকে। এরপর নিউমোনিয়া দেখা দেওয়া রোগী, যাঁদের আচরণ অসংলগ্নের পাশাপাশি শ্বাস–প্রশ্বাস রক্তচাপের জটিলতা (সিআরবি) থাকে। এরপর মারাত্মক রোগী, যাঁদের মারাত্মক নিউমোনিয়া ও সেপসিস (রক্তে সংক্রমণ) থাকে। সবশেষে জটিল রোগী। এঁদের থাকে এআরডিএস (অ্যাকুইট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম)। এঁরা সেপটিক শকে (রক্তচাপ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া) চলে যান।

রোগীর এই শ্রেণি বিভাগের পরে আছে কাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হবে, তার নির্দেশনা। সন্দেহভাজন ও কোভিড–১৯ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের চারটির কোনো একটি উপসর্গ থাকলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। উপসর্গগুলো হচ্ছে: ১. নিউমোনিয়ার সঙ্গে সিআরবি স্কোর হবে ১ বা তার বেশি; ২. নিউমোনিয়া পরিস্থিতি মারাত্মক; ৩. এআরডিএস, সেপসিস ও সেপটিক শক দেখা দিলে; ৪. রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৯৪ শতাংশের কম থাকলে। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দেখা দেবে, তাঁদেরও হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।

বাড়ির চিকিৎসা ফোনে

আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আইইডিসিআরের চিকিৎসকেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কে হাসপাতালে যাবেন, আর কে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন।’ তিনি আরও বলেন, উপজেলা পর্যায়ে কোনো রোগী শনাক্ত হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের নির্দেশনা মেনে সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সিভিল সার্জন আইইডিসিআরের সঙ্গে পরামর্শ করে নেন।

মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, বাড়িতে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের প্রত্যেককেই পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁদের বলা হয়, প্রয়োজনের সময় তাঁরা কোথায় ফোন করবেন। ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানীর বাসাবো এলাকার একটি পরিবারের ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। দুজন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। বাকি চারজনকে বাড়িতে থাকতে পরামর্শ দেয় আইইডিসিআর। ওই পরিবারের সদস্যরা গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, ১০ এপ্রিল রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রতি দুই দিন পরপর আইইডিসিআর থেকে ফোন করে, প্রত্যেকের পরিস্থিতি আলাদা করে জানতে চাওয়া হয়। প্রতিবারই প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়। ২৪ এপ্রিল চারজনের রক্তের নমুনা নেওয়া হয় সবাই রোগমুক্ত হয়েছে কি না, তা জানার জন্য।

আইইডিসিআর সূত্র জানিয়েছে, বাড়িতে থেকে সুস্থ হয়েছেন, এমন একাধিক ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষায় তা দেখা গেছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক রোগীকে সীমিত জনবল দিয়ে পরামর্শ দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে, এ কথা স্বীকার করেছেন আইইডিসিআরের পরিচালক। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা হতে পারে, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। আলোচনা হচ্ছে। কীভাবে সবাইকে কার্যকর সেবার আওতায় আনা যায়, তা–ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’

বাড়িতে সেবা

কোভিড–১৯ রোগীর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশনা তৈরিতে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যেক রোগীকে বাড়িতে পৃথক কক্ষে থাকতে হবে। যাঁদের পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, তাঁরা কাছের সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরে যোগাযোগ করবেন।

আহমেদুল কবীর বলেন, যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা পৃথক কক্ষে কিছু জিনিস বা সরঞ্জাম রাখতে পারেন। একটি পালস অক্সিমিটার: এটা আঙুলের মাথায় লাগালে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বলে দেয়। কোভিড–১৯ আক্রান্ত ডায়াবেটিসের রোগীরা সঙ্গে একটি গ্লুকোমিটার রাখতে পারেন। কক্ষে গরম পানির ভাপ নেওয়ার একটি আয়োজন থাকলে ভালো।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বাড়িতে রেখে করোনা রোগীর চিকিৎসার নির্দেশনা তৈরি করেছে। তারা বলেছে, রোগীর কাছে চিকিৎসকের নম্বর থাকতে হবে যেন প্রয়োজনের সময় রোগী যোগাযোগ করতে পারেন। বাড়ির রোগীর সেবার সঙ্গে জড়িতরা কোন ধরনের পোশাক, মাস্ক ব্যবহার করবেন, পরিচ্ছন্নতার কী বিধিনিষেধ অনুসরণ করবেন, তারও বিশদ বর্ণনা আছে নির্দেশনায়।

বাড়িতে থাকা রোগীরা টেলিফোনের মাধ্যমে মূলত চিকিৎসা সহায়তা পান স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩, আইইডিসিআরের ১০৬৫৫ ও ০১৯৪৪৩৩৩২২২ এবং সরকারি তথ্যসেবা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে। স্বাস্থ্য বাতায়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চিকিৎসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড–১৯ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে সহায়তা বা পরামর্শ চেয়ে ফোন আসছে ১ এপ্রিল থেকে। গত এক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ১১০টি ফোন আসছে বাড়িতে থাকা রোগীদের কাছ থেকে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় তাঁরা ফোন পেয়েছিলেন ১২০ জনের কাছ থেকে।

নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ হলে চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন, আইইডিসিআর বা অন্য চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র ঠিক আছে কি না, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, জরুরি বিশেষায়িত সেবা—এসব প্রয়োজনে রোগীরা এখন ফোন করছেন। বাড়িতে রোগী মারা গেছেন, তাঁর দাফন কীভাবে, কোথায় হবে—সেই পরামর্শ চেয়েও ফোন এসেছে স্বাস্থ্য বাতায়নে।