একদিন ঘর ছেড়ে শহরের পথে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ফোনটা বারবার বেসুরো সুরে বেজেছে। মনটা ভয়ে ভয়ে শিউরে উঠেছে। এর মধ্যে নামতে হবে। কয়েক দফা আলাপ–আলোচনা শেষে আজ অফিসে যেতে হলো। অতীব প্রয়োজন। পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত স্থিতি জড়তার সূত্রটি টের পেলাম মর্মে মর্মে, অঙ্গে অঙ্গে। একনাগাড়ে একটানা ২২ দিন ঘরে থেকে মনে হলো চার দেয়ালে শেওলার মতো আটকে গেছি। আমি অনন্তকাল এখানেই আটকে থাকতাম, যদিনা কেউ আমাকে ঠেলা দিয়ে ঘরের বাইরে না পাঠাত।

যেতে তো হবেই, এ এমন এক ডাক, যা উপেক্ষা করার সাধ্য বা সামর্থ্য কোনোটাই আমার নেই। সকাল সকাল উঠলাম, পুরোনো রুটিনে ফিরলাম, রান্নাঘর মোছা, ছেলেকে খাওয়ানো, টেবিলে দুপুরের খাবার রাখা, তারপর যাত্রার এন্তেজাম করা। আজ আবার বোতলে ক্ষার–পানি গুলে নিয়েছি, প্রয়োজনমতো জায়গায় জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হবে। মাস্ক ফাস্ক সব ঠিকঠাক পরে নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। মন অবশ্য দুশ্চিন্তায়, মনে হচ্ছিল করোনা ওত পেতে আছে শুধু আমাকে ধরবে বলে।


কিছুটা পথ হাঁটার পর রিকশা পেয়ে গেলাম। ব্যাগ থেকে ক্ষার–পানি ছিটিয়ে তবেই রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশা এগিয়ে চলেছে, আমি দেখছি চারপাশ। মনে হচ্ছে যেন কত দিন পর রিকশায় চড়লাম। বৈশাখ মাস হলেও রোদের মিঠে মিঠে তাপ, লাগুক না একটু গায়। খোলাই থাক হুড। তাপের প্রখরতা না থাকলেও রোদের জৌলুশ আছে, কী চকচক–ঝকঝক করছে চারপাশ। রাস্তাঘাট বেশ পরিপাটি, কোথাও আবর্জনার স্তূপ নেই, বোঝা গেল আজ সকালেও রাস্তায় ঝাঁটপাট হয়েছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা হয়তো কাজ করার সুযোগ এখনো পাচ্ছেন। বাসাবো, খিলগাঁও, সবুজবাগ, নন্দীপাড়া, মাদারটেক, কুসুমবাগ—এসব জায়গায় ঢাকার অন্যান্য অংশের চেয়ে গাছপালা কিছুটা বেশি বলেই আমার অনুমান। আমি ১৯৯৭ সাল থেকে ঢাকায় থাকি। বর্তমানে সবুজবাগে, বাসাবোতে থাকি। বেশি দিন নয় এখানে, গত বছরের অক্টোবর মাসে এসেছি।


আজ মনে হলো এই এলাকায় হরেক রকম সবুজের ছড়াছড়ি। একে তো বাস–ট্রাক বন্ধ, ধোয়া–ধুলির মলিনতা নেই, তার ওপর গত কয়েক দিনের ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে হালকা বৃষ্টিপাতে ধুয়ে গেছে বিবর্ণতার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু। রাজারবাগ কালীবাড়ি থেকে বৌদ্ধমন্দির পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে এখনো চোখে পড়ার মতো গাছপালা ঘিঞ্জি পুরোনো ময়লা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দালানকোঠার গায়ে গায়ে লেগে আছে। কতগুলো তো মাথা উঁচু করে দালান পেরিয়ে মুখ তুলে আকাশে মেলেছে ডানা। সকাল সাড়ে ৯টা, দিবসের পরিপূর্ণ প্রথম ভাগ। অন্য কোনো বড় গাছ না থাকলেও পাকুড়গাছ নেই—বাংলায় এমন কোনো জনপথ আছে বলে মনে হয় না। এখানেও পাকুড়গাছের ছড়াছড়ি। পাকুড়ের নবীন পাতায় বিলোল সবুজ বিচ্ছুরিত হচ্ছে আপন মহিমায়। বসন্ত যেমন ফুল ফোটার সময়, গ্রীষ্ম হলো বৃক্ষের নতুন পাতায় পাতায় সূর্যের লুকোচুরি খেলার সময়। পাতা পিছলে পিছলে আলো গড়িয়ে পড়ছে লোকালয়ে। ফাঁকা নিরিবিলি রাস্তায় রিকশা চলছে যেন হাওয়ায় হাওয়ায়। দুপাশে ভ্যানে, দোকানে সবজি। সেখানেও সবুজের দাপাদাপি। ঢাউস সব তরমুজ, কালো সবুজ উচ্ছে আর টসটসে সবুজ কচি আম, সঙ্গে অন্যান্য শাকপাতা। লোকজনও আছে, ১২টার পরে সব বন্ধ হয়ে যাবে।


বাসাবোতে লকডাউন চলছে অনেক দিন থেকে। দেখতে দেখতে রিকশা বৌদ্ধমন্দির পার হয়ে মূল সড়কে উঠে গেল। সেখানে তিন–চারজন পুলিশ, কিছুই বলল না। চওড়া রাস্তা, বাতাস যেন এখানে এসে হাঁপ ছেড়েছে। একটা কাভার্ড ভ্যান চলে গেল পাশ দিয়ে। হাতে গোনা কয়েকটা রিকশা তিড়িং বিড়িং করে চলছে, মতিঝিল অভিমুখে চলছি। হাতের ডান দিকে উঁচু পাঁচিল, ওপাশটা বিস্তৃত কমলাপুর রেলস্টেশন। ঘন বনের মতো নিবিড় বৃক্ষের আচ্ছাদনে ঘেরা। আরেকটু যেতেই দেখি মুগদা আইডিয়াল স্কুলের প্রবেশপথের কাছে একটি সোনালু গাছ। আরে একি! সোনালু ফুল দুলছে বাতাসে, চনমনে হলুদ ফুলগুলো যেন লাজুক হাসি হাসছে। আমি ২২ দিনের আটকাবস্থা থেকে মুক্তির স্বাদ অনুভব করলাম, শিহরিত হলাম রোদ আর সোনালু ফুলের মাখামাখি দেখে, আহা! জীবন কত সুন্দর! গাছপালা, লতাপাতা, ফুল, পাখি, নদী, আকাশ, চন্দ্র–তারা এসব এত দেখেও তৃষ্ণা মেটে না। সোনালু ফুলের সোনালি আভা শেষ হতে না–হতেই দেখি জারুলের ঘন পত্রপল্লবের ফাঁকে ফাঁকে বেগুনি ফুল ফুটবে কি ফুটবে না করেও ফুটেছে কিছু কিছু। আমার আজন্ম চেনা জারুল, যতবার দেখেছি এই জীবনে, ততবারই একটু হলেও থেমেছি। আজ তো রিকশাসওয়ারী, তাই একপলকের ক্ষণিক দেখার অতৃপ্তি নিয়েই সামনে তাকালাম।


টিটিপাড়া মোড় ঘুরল রিকশা। এই মহানগরীর মানুষের মনে ঘোর অমানিশা, অথচ বাইরে আলোর কি উদ্ভাস! দেয়ালে দেয়ালে আলো গা এলিয়ে শুয়ে–বসে আরাম করছে। এসে পড়লাম দেওয়ানবাগী হুজুরের উটের খামারের কাছে। সুউচ্চ পাঁচিলের ওপাশে নাকি উট আছে, দেখিনি, কিন্তু উটের উটকো গন্ধ বলে দেয় তারা ভেতরে আছে। অন্যান্য দিন গন্ধটাকে উটকো মনে হলেও আজ কেমন পরিচিত গন্ধটাও ভালো লাগল। একটু এগোতেই ঝম বৃষ্টির মতো একপশলা বৃষ্টিতে যেন ভিজে গেলাম আমি, আমার চোখের কোণে জল, হিজলগাছ! এ যে হিজল! কিশোরীর চুলের বেণির মতো ঝুলে ঝুলে আছে হিজল ফুলের কলি, এখনো ফুল ফোটার সময় হয়নি, ফুটবে শিগগিরই। এ পথে কত করেছি আসা-যাওয়া অথচ তোমায় দেখিনি প্রিয়া। হিজল তো আমার সেই ছোট্টবেলার সই, কত গেঁথেছি মালা, কতবার পরেছি গলায়, হিজলের রঙে–রূপে বিমোহিত হয়নি এমন বাঙালি কি আছে। অনেক দিন পর দেখলাম কিশোরী হিজল কুসুম কন্যারে, এত দিন পর দেখে আনন্দ উপচে উঠেছিল চোখের সীমানা বেয়ে।


ভাবালুতা কাটাতে কাটাতে দেখি রিকশা মতিঝিল শাপলা চত্বরে। অন্য রকম মতিঝিল, যেন পূর্বজন্মে ফিরে গেছে। হয়তো পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে মতিঝিল এমন নিরিবিলি ছিল। তখন মতিঝিল মতিঝিল হয়ে উঠেছিল, নাকি শুধু ঝিল ছিল, মতি ছিল না কোনো। মতিঝিল কবে থেকে ব্যাংকগুলোর রাজধানী হতে শুরু করল, সে ইতিহাস বিস্তারিত জানা নেই। সামনেই নামব, আমার অফিসে। আর তখন মনে হলো কত কম জেনেই জীবন গড়িয়ে গেল অপরাহ্ণে।

*লেখক: সুপ্তি জামান, দক্ষিণগাঁও, বাসাবো, সবুজবাগ।