সমন্বিত পদক্ষেপে আতঙ্কের শিবচরে ফিরছে স্বস্তি

ক্রেতার ছদ্মবেশে কাঁচামালের বাজারে শিবচর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ। রোববার সকালে উপজেলার পৌর বাজারে। ছবি: প্রথম আলো
ক্রেতার ছদ্মবেশে কাঁচামালের বাজারে শিবচর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ। রোববার সকালে উপজেলার পৌর বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

মাদারীপুরের শিবচরে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন গত ১৩ মার্চ। ইতালিফেরত ওই ব্যক্তির মাধ্যমে দ্রুতই সংক্রমিত হন তাঁর ঘনিষ্ঠ সাতজন। দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে এই ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। কিন্তু সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপের কারণে শিবচরে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হয়েছে। ফিরে আসছে স্বস্তি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঠিক নজরদারি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, মানুষজনকে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি দ্রুত বোঝাতে পারা, বিধিনিষেধের মধ্যে থাকা লোকজন ও অসহায় ব্যক্তিদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া। এভাবে প্রতিটি কাজ সমন্বিত ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় শিবচরে এখন পর্যন্ত করোনার কমিউনিটি সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মাদারীপুর জেলা কমিটির সভাপতি রাজন মাহামুদ প্রথম আলোকে বলেন, শিবচর করোনা মোকাবিলায় উন্নতি হচ্ছে, এটি যেমন সঠিক, তেমন ঝুঁকিও আছে। সিদ্ধান্তে একটু ভুল ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ। সব নাগরিককে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর জেলার করোনার মোকাবিলার চিত্র দেখে ভয়াবহতা অনুভব করতে হবে। শিবচরে লকডাউন আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। এমনকি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকায় কাজ করতে হবে। পাশাপাশি আরও অন্তত তিন মাস সরকারি ত্রাণসহায়তা চলমান রাখতে হবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ১৯ মার্চ রাত থেকে শিবচর উপজেলাকে নিয়ন্ত্রিত এলাকা (কন্টেইনমেন্ট) ঘোষণা করা হয়। দেশে এটাই ছিল এমন প্রথম ঘটনা। এই পদক্ষেপ নেওয়ার যৌক্তিক কারণ ছিল। ১৯ মার্চ সারা দেশে মোট আক্রান্ত ১৭ জনের মধ্যে আটজনই ছিলেন এই শিবচরের। ৫ এপ্রিল উপজেলায় আবার তিনজনের শরীরে করোনা পাওয়া যায়। তখন পুরো শিবচরকে লকডাউন ঘোষণা করে প্রশাসন। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত উপজেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা স্থিতিশীল ছিল। ১২ এপ্রিল করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মেলে প্রথম আক্রান্ত সেই ইতালিফেরত ব্যক্তির এক প্রতিবেশীর শরীরে। একই সময়ে আক্রান্ত হন ওই এলাকার এক শিক্ষকও।

গতকাল রোববার দুপুরে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলে, উপজেলায় ১৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ১১ এপ্রিলের পর থেকে নতুন করে কোনো সংক্রমণ নেই। করোনা জয় করে সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। আইসোলেশনে চিকিৎসা নিচ্ছেন চারজন। আপতত হোম কোয়ারেন্টিনেও কেউ নেই। করোনায় শিবচরে দুজন মারা গেছেন। গত শনিবার যিনি মারা গেছেন, তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার কাজ চলমান আছে। নতুন মারা যাওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা কয়েকজনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কন্টেইনমেন্ট এলাকা ঘোষণার পরপরই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি দল শিবচরে আসে। তারা এখানে অবস্থান নিয়ে প্রথমে আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসা মানুষের তালিকা তৈরি করে। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা ও সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ফলে অন্যান্য স্থানে যেখানে করোনার বড় বিস্তার ঘটেছে, সেখানে শিবচর উন্নতির দিকে হেঁটেছে। পুরো মাদারীপুর জেলাতেও পরিস্থিতি অতটা খারাপ হয়নি। অথচ, বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি বড় সংক্রমণের দিকে গড়ানোর পরও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৮৪ জন শিবচরে এসেছেন। ওই ৬৮৪ জনের মধ্যে অন্তত ৫০০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। পাশাপাশি এ পর্যন্ত উপজেলায় ১২ হাজারের বেশি দরিদ্র পরিবারে খাবার সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে মানুষকে ঘরে রাখা তুলনামূলক সহজ হচ্ছে।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘করোনা ঠেকাতে এক মাসের বেশি সময় ধরে শিবচর উপজেলায় দোকানপাট, গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। মাত্র চার ঘণ্টা খোলা থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান। জনসমাগম এড়াতে বন্ধ রয়েছে সব সাপ্তাহিক হাট। ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠন করে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসী ও দরিদ্রদের খাবার সহায়তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে প্রশাসন। সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ১২ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিইসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। সবার বিশেষ সহযোগিতায় করোনার প্রতিরোধ ঠেকাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

মাদারীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (শিবচর সার্কেল) আবির হোসেন বলেন, করোনা প্রতিরোধে আড়াই শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিটি ইউনিয়নের একজন করে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী, র‍্যাবের টহল রয়েছে পুরো উপজেলাজুড়ে। যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশসদস্যরা তৈরি রয়েছেন।