ঢাকা মেডিকেলে করোনা রোগীদের ভর্তি শুরু হচ্ছে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দু-এক দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি শুরু করে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে করোনায় আক্রান্ত ৩০০ রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেবে দেশের সর্ববৃহৎ এই সরকারি হাসপাতাল। আর দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬০০ করোনা রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আগামীকাল শুক্রবার থেকে আমাদের হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভর্তির কার্যক্রম শুরু করতে পারব। কোনো কারণে আগামীকাল যদি রোগীর ভর্তির কার্যক্রম শুরু না হয়, তবে আগামী শনিবার কোনোভাবেই মিস হবে না। প্রথম ধাপে ৩০০ করোনা রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। পরের ধাপে আরও ৬০০ থেকে ৭০০ করোনা রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা রোগীর পাশে থেকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাবে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অন্তত এক হাজার করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭ হাজার ৬৬৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১৬৮ জন। দিন যত যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পুরান ঢাকার নয়াবাজারের মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। এর বাইরে আরও কয়েকটি হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেলে করোনা চিকিৎসা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের বার্ন ইউনিট ভবনটি করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও আইসোলেশন ইউনিট। বার্ন ইউনিটের সব রোগীকে ঢাকা মেডিকেলে কাছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।

এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে করোনা ইউনিট করার কাজটি বেশ বড়সড় ব্যাপার। একটা নতুন হাসপাতাল তৈরি করার মতো। বার্ন ইউনিট তো আলাদা প্যাটার্নের হাসপাতাল। এখন সেটাকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল করতে হচ্ছে। এখানে মেডিসিন বিভাগ থাকবে, সার্জারি বিভাগ থাকবে, প্রসূতি বিভাগ থাকবে, শিশু বিভাগ থাকবে, অর্থোপেডিকস থাকবে, ইউরোলজি বিভাগ থাকবে। আমরা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছি। একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। কোভিড-১৯–এর রোগীদের চিকিৎসা করা তো আরেকটা চ্যালেঞ্জ। সব ঠিক করে ফেলেছি। ডাক্তার, নার্সদের হোটেলে রাখতে হবে। তাঁদের আনা-নেওয়ার জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের গ্রুপ ওয়াইজ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো বেশ বড়সড় কর্মযজ্ঞ। এসব কর্মকাণ্ড একেবারই শেষ পর্যায়ে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। প্রথম আলো
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। প্রথম আলো

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তার সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবে বলে মন্তব্য করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, শনিবার থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা শুরু হবে। আমরা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আইসিইউ স্থাপন করেছি। আবার রোগীদের ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেখানে অপারেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। থাকবে প্রসূতি, সার্জারি ও নিউরো সার্জারি বিভাগ, যদি তা লাগে। আমাদের সব এক্সপার্ট দিয়ে একটা গ্রুপ করেছি। আমরা যেটা পারব, অনেকের পক্ষে সেটা পারা সম্ভব হবে না। আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের দৃঢ়তা রয়েছে। এই ক্রান্তিকালে দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল মানুষের পাশে থাকবে। আগে থেকে আমরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। করোনাভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পিছিয়ে থাকবে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।’

ঢাকা মেডিকেলে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই বলে জানান পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম আছে। গত আড়াই বছরে আমি আড়াই হাজারের ওপরে লাইন যোগ করেছি। আগে ছিল দুই হাজার। অর্থাৎ আমার হাসপাতালে সাড়ে চার হাজার অক্সিজেন কেন্দ্রীয়ভাবে সাপ্লাই করার সক্ষমতা রয়েছে। যেখানে সারা ঢাকার সব হাসপাতাল মিলিয়ে এত অক্সিজেন সাপ্লাই আছে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন খুবই প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। সেখানে আমরা দুর্বল নেই। দ্বিতীয়ত, রোগীদের জন্য যে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট লাগবে, সেটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০ শয্যার একটা আইসিইউ রেডি করে ফেলেছি। মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট লাগে। বাকি ১৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে লাগছে কিন্তু অক্সিজেন। আমরা বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রোগীর সেবায় নামছি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ব্লক ভবনে (ডিএমসি করোনা ইউনিট-২) চালু করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, যেটাকে করোনা ইউনিট হিসেবে স্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে পারব। আরও বেশি করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে। যেভাবে রোগী বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে, আগামী এক-দুই মাস তো বৃদ্ধির দিকে যাবে। সে জন্য ঢাকা মেডিকেল (ডিএমসি-২) করোনা ইউনিট চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বার্ন ইউনিটের চালু করা করোনা ইউনিটে যখন আর রোগী ভর্তি নেওয়া সম্ভব হবে না, তখন ডিএমসি-২ করোনা ইউনিটে রোগী ভর্তি শুরু করা হবে। এখন এত বেশি করোনা রোগী বেড়ে যাচ্ছে। মাল্টিপল রোগীরাও কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে আসছেন। এসব রোগীকে তো কেউ ম্যানেজও করতে পারছে না, নিতেও চাচ্ছে না। আমাদের এসব রোগীকে নিতে হবে।’

এ কে এম নাসির উদ্দিন আরও বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন যে মেডিসিন ব্লক (ডিএমসি-২), সেখানে ৬০০ শয্যা রয়েছে। ওখানে আমাদের ১ হাজার ২০০ রোগী থাকত। ডিএমসি-২ করোনা ইউনিট প্রস্তুত করতে সাত থেকে দশ দিন লাগতে পারে। ওখানে আমাদের নেফ্রোলজি সেন্টার আছে, কার্ডিওলজি বিভাগ আছে, আছে সার্জারি বিভাগও। যেহেতু ঢাকা মেডিকেলে প্রতিদিন আমাকে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা করতে হয়, তাদের আমরা ভর্তি করছি। একই সময়ে একই ক্যাম্পাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী নিয়ে আসা আমাদের জন্য খুবই রিস্ক এবং খুবই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেওয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। ফাইল ছবি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। ফাইল ছবি

করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দুটি লেয়ারে আমরা কাজ করব। একটি হচ্ছে করোনায় যেসব সাসপেক্টেড কেস আসবে, যাদের করোনা টেস্টটা হয়নি। এসব সন্দেহভাজন রোগীদের কিন্তু আমরা ভর্তি করব। এটা কিন্তু কেউ করছে না। এগুলো আমরা করব। আমরা তো করোনাভাইরাস শনাক্তের টেস্ট করে আসছি। যাদের কোভিড-১৯ পজিটিভ আসবে, তাদের আমরাই চিকিৎসা দেব। আমরা আর কোথাও তাদের পাঠাব না। সেটা হচ্ছে সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে ব্রিগেডিয়ার এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল। সেখানে সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৫ জন ডাক্তার, ৪০ জন নার্স এবং ১০ জন কর্মী কোভিড-১৯ পজিটিভ। একদিকে জীবাণুমুক্ত করছি, অন্যদিকে রোগী ভর্তি করছি। আমাদের ডাক্তার-নার্সদের অনেকে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন, অনেকে হোম সিকনেসে আছেন। অনেকে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। অনেকে কোয়ারেন্টিনে আছেন। তারপরও কিন্তু আমরা আমাদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও আমরা চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাব। আমাদের অনেক ডায়ালাইসিসের রোগী আছে। আমার হাসপাতালে কার্ডিওলজির রোগী আছে। আমার এখানে ক্যানসারের রোগী আছে। এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন ১৯৪ জন ব্যক্তির করোনার নমুনা পরীক্ষা করছে জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘করোনা শনাক্তের জন্য আমাদের মেডিকেল কলেজে একটা মেশিন রয়েছে। আমরা আরও একটি মেশিনের সরবরাহের জন্য আবেদন করেছি। ওই মেশিন হাতে পেলে আরও বেশি করোনা শনাক্ত পরীক্ষার কার্যক্রম চালাতে পারব।’