আঁধারের পর আলো আসবেই

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারণে বুদ্ধিমান মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে! পালিয়ে কত দিন বেঁচে থাকতে পারবে? অথচ প্রকৃতির সবকিছু কী সজীব! প্রকৃতির সব জীব আনন্দ করছে। গাছের সবুজ পাতার দিকে তাকাও। কী সুন্দর চিকচিক করছে! ওরাও মুচকি হাসছে। নদীর পানির দিকে তাকাও। ওখানেও পানি স্বচ্ছ হচ্ছে। সকালে কংক্রিটের দালানের কাছে পাখি ডাকছে। আনন্দে নাচছে ওরাও! অথচ তুমি কিংবা তোমার অন্তর স্বচ্ছ হচ্ছে না! হে মানুষ, তোমার শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? তোমার সঙ্গে পিঁপড়া কিংবা এমিবার কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃতির এই খেলা কি তুমি টের পাও!

সকালে একটু পড়ালেখা করলাম। পত্রিকা দিল না আজ। ঘুম থেকে উঠে অন্তত হেডলাইনগুলো চোখ বুলানো হতো। আজ সেটাও বন্ধ! পরিস্থিতি বুঝতে তাই সকালে একটু হাঁটতে বেরোলাম! কেমন জানি শূন্য রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। দু-একজন মানুষ যা দেখলাম রাস্তায়, তাদের চোখ উদ্বিগ্ন! অনির্বচনীয় ভয়ে ভাসা। কাঁচাবাজার খোলা। দু-একটা ওষুধের দোকান খোলা! কোনো রিকশা দেখলাম না! গলির দোকানগুলো বেশির ভাগ বন্ধ! জানি না এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতি কবে কাটবে! খুবই বিমূর্ত সময়! এমন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রতি এমনি এমনি ভালোবাসা জাগে। মায়া জাগে। দরদ জাগে। আসলে সবার মঙ্গল কামনা করা ছাড়া আমাদের আপাতত কোনো অপশন নেই!

মহামারিতে দুভাবে প্রাণ সংহার হয়। এক. অজানা অপ্রতিরোধ্য রোগে। দুই. অভাবনীয় খাদ্যাভাবে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ব্ল্যাক ডেথে লোক মারা যায় আনুমানিক সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১০ কোটি! শুধু ভেনিসেই মারা যায় ১ লাখ মানুষ। গোটা ইউরোপে ৪ বছর ছিল সেই মহামারির ভয়ানক দশা!

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দুদিন আগে ইতালির একজন কবি ও বিজ্ঞানীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা হলো। সিলভিয়া দ্য অ্যাঞ্জেলো জানালেন, ইতালির শিল্পাঞ্চলগুলোয় করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বেশি। মৃত্যুর হারও অত্যধিক। আমাদের দেশেও শিল্পাঞ্চল ও ঘনবসতি এলাকায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। মোটামুটি দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর সব দেশে করোনা সংক্রমণের চিত্র একই।

মানুষ নিঃসঙ্গ। মানুষের কাছে দুনিয়া এখন অবিশ্বস্ত কারাগার! এমন নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে মানুষের বহুদিন লাগবে। খোলা আকাশের নিচে নিরাপদে প্রাণখুলে কবে যে নিশ্বাস নেবে দুনিয়ার মানুষ। কবে সেই সুদিন আসবে!

সাঁঝের বেলায় সন্ধ্যাতারা। খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম আজ সন্ধ্যা নাগাদ। একটা অপ্রকাশিত লেখার দুটো বাক্য ঠিক করতে করতে এত ক্লান্ত হয়েছিলাম বুঝি! ঘুম থেকে উঠে ভাবছি, সকাল হচ্ছে না কেন? বাইরে তাকাই সূর্য দেখি না। ঘড়িতে তাকাই সাড়ে সাতটা। আজ পৃথিবী কি পাল্টে গেল? আজ কি সূর্য উঠবে না! একটা গোলকধাঁধায় থাকতে থাকতে বিদ্যুৎ চলে গেল! আমি বাতাসের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বাতাস মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথা। মনে হচ্ছিল বাতাস গাছের কথা বয়ে আনছে আমার কাছে। আমি নিশ্বাস নিলাম পরম আনন্দে। আর হঠাৎ আলো হয়ে উঠেছিল সবকিছু। এত সুন্দর আলো আর কখনো দেখিনি! তাতে কি জীবন ছিল অন্যমনস্ক! নাকি আমি শুধু মৃত্যুর কথা ভাবছিলাম!

এসব বিষণ্ন সন্ধ্যা, ডেথ সার্টিফিকেটের ভেতর অসহায় তাকিয়ে থাকা সন্ধ্যা, ঘুম ভেঙে জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়া সাঁঝবেলা—বন্দী গোধূলির নিরন্ন প্রবাহ পৃথিবীর পাশে অনন্তকাল হয়ে যাচ্ছে, বড় হচ্ছে! দিনে দিনে বাড়ছে চোখের চেয়েও বেশি অশ্রু। নীরব সুরে চোখের বিপরীত দিক থেকে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, আমরা বেঁচে থাকি মৃত্যু-গণনার মোহে।

সন্ধ্যা নামে। জগৎ ধীর হয়ে গুলিহীন পিস্তলের মতো বসে থাকে আমার ভেতরে! আমি ভবঘুরে? সিলিং ফ্যানের গভীর বাতাসে আত্মহত্যার দড়ি হাতে এই সন্ধ্যা আমায় নিয়ে ঘুরছে ঘরের কাছের গীতাঞ্জলি সড়কে, নতুন কোনো ডেথ সার্টিফিকেটের উষ্ণতায় আমাকে অজস্রবার ঘুম পাড়াবে বলে?

কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স
কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স



অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে,
বাস্তবতা মানুষকে একা করে দিচ্ছে ক্রমাগত।
একসঙ্গে থেকেও যেন নিঃসঙ্গ ভীষণ,
এমনটা কি কেউ ভেবেছি কখনো?
জীবন নিয়ে বাঁচতে হলে মানতে হবে,
নিয়ম মেনে চলতে হবে,
হ্যাঁ ঘরে থাকা শিখতে হবে।
সবাই মিলে আবার নতুন করে বাঁচতে হলে
একা থাকা শিখতে হবে।

করোনার শেষ কোথায় কেউ জানে না! মৃত্যু প্রত্যেকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরও মানুষের কাণ্ডজ্ঞান হলো না। এত আত্মবিধ্বংসী কেন মানুষ?

আতঙ্ক ছড়ানোর কিছু নেই কিন্তু নিরাপদে থাকুন! পৃথিবীর সব জনপদ থেকেই ভয়–বিষাদের খবর আসছে। বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরায় করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত খবরে কারও মন ভালো থাকার খবর নেই। বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরের কোনো গ্রহ নয়।

কৃষি, বস্ত্রশিল্প, জনশক্তি—প্রধান তিন আর্থিক খাতই গভীর সংকটে। দেশের অবস্থা চিন্তা করে ঘুম হয় না রাতে। রাত বা ঘুম না থাকলে খুব অসুবিধা হতো কি? না রাত না ঘুম, কেবল সময় এবং আমি!

কৃষকের কান্নায় জমির মাটি ভেজে। ঋণের টাকায় চাষ করা ফলন মাঠেই পচে যাচ্ছে, ক্রেতার অভাবে লাখ টাকার ফসল মাটিতে মিশে যাচ্ছে। কৃষক না বাঁচলে দেশের মানুষ বাঁচবে না।

হাওরের ধান কাটায় হারভেস্টার ব্যবহারে ইতিবাচক সূচনা। ভবিষ্যতে সমবায়, বাণিজ্যিকভাবে সারা দেশে পর্যাপ্ত হারভেস্টার ব্যবহারে ধান চাষের অনিশ্চয়তা দূর হবে। দ্রুত সময়ে স্বল্প খরচে ধান পাবেন কৃষক। সমস্যা থেকেই সমাধান। করোনার ইতিবাচক অবদান!

বাসার কাছে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। এ যেন কংক্রিটের ঢাকা নয়। আমাদের সেই প্রাচীন গ্রাম! কত বছর পর ডাক শুনলাম। আহা, প্রকৃতির বিন্যাস!

এ রকম বৈশাখ দেখেছি মনে পড়ে না। জানালাও সব খোলা রাখতে হয় না। মেঝে মোছার সময় বৈদ্যুতিক পাখা না ছাড়লে এগুলোর অস্তিত্বও মনে পড়ত কি না সন্দেহ আছে। এ রকম চলছে অন্তত এক সপ্তাহের বেশি হবে। দুদিন ঝড় বাদে শুধু বৃষ্টি। দিনে একবার তো বাঁধা, তিন চার দফাও হয়। এবার বজ্রশব্দও যেন কম। ওয়েদার অ্যাপে আগামী দুই সপ্তাহে বৃষ্টিবিহীন দিন নেই বললেই চলে। এই মুহূর্তে নিরিবিলি মাঝারি ধারার বৃষ্টি। দূরে–কাছে মেঘের ডাকও স্বাভাবিক। পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে দুপুরে খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ আমাকে খাটের উল্টো দিকের মেঝেতে চলে যেতে বাধ্য করেছিল। অনেকটা ছুড়ে ফেলার মতন। আমি কয়েক সেকেন্ড ভয় তাড়ানো ড্যান্স শুরু করেছিলাম অজান্তেই। বিস্তর হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। এ রকম শব্দ আর শুনতে পাচ্ছি না। অন্যান্যবার কেবল বৃষ্টি ছাড়া বজ্রশব্দেও মেঘ কেটে যেতে দেখেছি। গর্জে যত, বর্ষণে তত না, দেখা মেলেনি। মেঘ না হতেই যেন বৃষ্টি। আরও কয়েকজন অনুরূপ বলেছে। বড় ঘটনায় বিমূঢ় সবকিছুতেই পরিবর্তন দেখছি, এ রকম মনে হওয়া অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। বৃষ্টির ধারা, শব্দ একদম আষাঢ় মাসের মতন। এক ঘণ্টার বেশি নামছে। এই মাত্র পশ্চিমাকাশের চেহারা পাল্টে অল্পক্ষণে রোদের দেখা মিলবে, সে রকম আভাস। আজকের বৃষ্টিতে আমার গাছের একটি আমও পড়েনি।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

বৃষ্টি না, যেন ঢল। কালবৈশাখী লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। নামছেই। এ রকম শব্দময় অথচ নিরীহ বৃষ্টি এই ঋতুতে ভাবা যায়? পৃথিবী মনে হয় দ্রুত বদলাচ্ছে। করোনা অজুহাত মাত্র। 

ঝুম বৃষ্টি শুরু হয় সন্ধ্যামালতী ফুল যখন ফোটে তার পরপর! মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ে, কেননা এই বৃষ্টিতে জল পড়ে না একফোঁটাও! সবাই নেমে গিয়ে দেখে বৃষ্টিধারার মতো আকাশ থেকে অবিরাম চাল পড়ছে! ক্ষুধার্ত মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না এটা কী ঘটতে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে, ফলে তারা জড়ো হয়ে দেখতে থাকে! এবং ক্রমে রাস্তাঘাট, নর্দমা, পুকুর, উঠোন, মাঠ চালে ভরে ওঠে! ক্ষুধার্ত মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে! ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর চোখে ঘুম এসে যায়, চাল–ধোয়া আকাশে চাঁদ ওঠে! সেই আলোর মধ্যে এই নিরন্ন মানুষগুলোর কারও কারও মনে হয়, কত আর ক্ষুধা সহ্য করবে, কারও কারও মনে হয়, এসব দেখার চেয়ে আত্মহত্যা উত্তম! আবার কারও কারও মনে হয়, একজন মানুষের কতটুকু চাল প্রয়োজন এক জীবনে?

এমন বিষণ্ন ঢাকা আমি কখনো দেখিনি আগে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। কথা হবে।

সামনের অনাগত দিনগুলোয় দুর্দশা হয়তো আরও বাড়বে। বাড়বেই! সেই দুর্দশার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি রাখা উচিত। এই অতিমারি শুধু মৃত্যু নিয়ে আসেনি, সঙ্গে এনেছে দারিদ্র্য, অনাহার, দুর্ভিক্ষ আর সর্বোপরি মহান ঐশ্বরিক সত্তার সীমাহীন ক্রোধ! এই ক্রোধ যৌক্তিক।

অনেক কিছুই নিঃশেষ হয়ে যাবে সুনিশ্চিত। যাঁরা থেকে যাবেন, হয়তো তাঁদের নতুনভাবে শুরু করতে হবে জীবন নামের এই অত্যাশ্চর্য ভ্রমণ। সেই যাত্রা কেমন হবে, তা জানি না। আগ্রহও নেই জানার। সময় নামক নিয়তি তা ঠিক করে দেবে নিশ্চয়ই...

রয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে কেউ একজন হয়তো এক বৃষ্টিভেজা সকালে খোলা রাস্তায় বুকভরা নিশ্বাস নিয়ে বলবে, ‘মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম...’ সকলের কল্যাণ হোক!

সুপ্রিয় পাঠক, করোনাভাইরাসের যন্ত্রণা আর লকডাউনে অস্থির হয়ে আমরা এখন অনেকেই করোনাকে নিয়ে হাসি–তামাশায় মেতে উঠেছি। কিন্তু বিপদ এখনো কেটে যায়নি।

রাতের আঁধারে এক টুকরো ভোরের আশায়। করোনাকালের রাত কাটে! সবাই ভালো থাকবেন। ইনশা আল্লাহ, আঁধারের পর আলো আসবে, এটাই সত্য।

*লেখক: বিবিএ শিক্ষার্থী