'করোনায় আতঙ্কিত হয়ে বিপদ ডেকে আনবেন না'

কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

‘করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর অনেকে অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছেন। করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। কেউ যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছেন, তখন তাঁর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের চাহিদা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আতঙ্কিত অনেক রোগীই কিন্তু এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। এর ফল কিন্তু খারাপ হয়। তাই এ ভাইরাসে সংক্রমিত হলে মোটেও আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। নির্ধারিত কোভিড হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।’

প্রথম আলোকে এসব কথা বলেছেন করোনায় সংক্রমিত রোগীদের জন্য সরকার–নির্ধারিত প্রথম চিকিৎসাকেন্দ্র কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। করোনা হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটির (আইসিইউ) নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই চিকিৎসক। দুই মাস ধরে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বহু করোনা রোগীর আচরণ।

চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘কোভিড-১৯ রোগটি কিন্তু নরমাল ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা ফ্লুর মতো একটি রোগ। আমরা কেউ যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে যাই, তখন নিজেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলব। আইসোলেশনে থাকব। দেশে এখন অনেক কোভিড-১৯ হাসপাতাল রয়েছে। এর যেকোনো একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেব। আমার অভিজ্ঞতা, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশ কিন্তু ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। যাঁদের ডায়াবেটিস নেই, হাইপার টেনশন নেই, কার্ডিয়াক কোনো ডিজিজ নেই, সে ক্ষেত্রে রোগীদের আউটকাম কিন্তু অনেক ভালো। হাসপাতালে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের কিডনি রোগ ছিল, সেই রোগীরাও কিন্তু ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।’

কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।

করোনায় সংক্রমিত রোগের ভয়াবহ দিক হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। এ দিকটি তুলে ধরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, ‘যাঁরা ধূমপায়ী, তাঁদের ফুসফুস এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে ধূমপায়ী যাঁরা করোনায় আক্রান্ত, তাঁদের ফুসফুসের জটিলতা অধূমপায়ী রোগীদের চেয়ে বেশি। আমাদের ফুসফুস অজস্র বেলুনের সমষ্টি। যখন আমরা বাতাস নিই, তখন ফুসফুসের বেলুনগুলো ফুলে ওঠে। ফুসফুসের বায়ুথলি থেকে অক্সিজেনগুলো রক্তে মিশে যায়। যাদের ফুসফুস অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, অক্সিজেন দিয়েও কিন্তু ফুসফুসের বেলুনগুলো ফোলানো যায় না। যে কারণে রোগীর দেহের কোষে অক্সিজেনের মাত্রাটা অনেক কমে যায়। কোভিড-১৯–এ যত মৃত্যু হচ্ছে, তার প্রধান কারণ কিন্তু রোগীর রক্তের ভেতর অক্সিজেন না যাওয়া। আমাদের প্রধান যে অঙ্গগুলো আছে, যেমন হার্ট, কিডনি, লিভার—এগুলো অক্সিজেনের অভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আল্টিমেটলি মাল্টি অর্গান ফেইলারের মাধ্যমে কোভিডে আক্রান্ত রোগীরা মারা যাচ্ছেন।’

করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের বড় ওষুধ অক্সিজেন বলে মন্তব্য করে চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্ট হয়। তাঁদের রক্তে যদি অক্সিজেন প্রবেশ না করে, তাহলে কিন্তু ভাইটাল (গুরুত্বপূর্ণ) অর্গানগুলো কমপ্রোমাইজ হবে। মানুষের দেহের প্রতিটা কোষের যে কার্যক্রম, যে পাওয়ার হাউস, যেখান থেকে আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়, সেটা তৈরি করতে কিন্তু অক্সিজেন লাগে। আমাদের শরীরে যদি অক্সিজেন কমে যায়, তাহলে শরীরের জন্য যে পরিমাণ শক্তি বা ক্যালরি দরকার, সেটা তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ, অক্সিজেন ইজ ম্যান্ডেটরি। করোনা রোগীদের যত চিকিৎসা আছে, তার মধ্যে অক্সিজেন হলো সবচেয়ে বড় ওষুধ।’

চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বলেন, 'যেকোনো বয়সের মানুষ, যেকোনো সময় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হতে পারে। ছোট শিশু থেকে বয়স্ক—সব বয়সী মানুষ কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ইয়ং ব্লাডদের মধ্যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব। তারা কিন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে মনে করছে, তাদের কিছুই হবে না। হাসপাতালে আমরা দেখছি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ ভর্তি হচ্ছেন। তাই নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে আমাদের সতর্ক হয়ে চলা উচিত। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এখন কারও ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।'

করোনায় সংক্রমিত যাঁদের লক্ষণ নেই, তাঁরা কিন্তু রোগ ছড়াচ্ছেন বলে মন্তব্য করে চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বলেন, 'আমাদের দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপারটা হলো, অনেক রোগী কিন্তু এসিমটোমেটিক। তাদের কোনো উপসর্গ কিংবা লক্ষণ নেই। জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, কিছুই নেই। এসব ব্যক্তিই সবচেয়ে ভয়ংকর। এই ক্যারিয়াররা সবার সঙ্গে মিশে বেড়াচ্ছে। যে রোগটা একজনের থেকে আরেকজনে ছড়ায়, এমন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে বড় সফলতা। আমরা যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রুখতে পারি, তাহলে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা কমে আসবে।’

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ফাইল ছবি
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ফাইল ছবি

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিউতে ভর্তি হওয়া ৪০ জন রোগীর মধ্যে ১৬ জন মারা গেছেন বলে জানান আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রতিটা মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক। আমরা ডাক্তাররা মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখি। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ আইসিইউতে কাজ করছি। আইসিউতে ভর্তি হওয়া অনেক রোগী কিন্তু ভালো হচ্ছেন। আমরা রোগীদের বাঁচানোর সব চেষ্টা করে থাকি।’

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ২৬ শয্যার আইসিউ থাকলেও চালু আছে ১০টি আইসিউ।

চিকিৎসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘করোনা রোগীদের জন্য প্রথম ডেডিকেডেট হাসপাতাল হলো কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল। এখানকার আইসিউ আমার হাতে শুরু। আমাদের হাসপাতালে ২৬ শয্যার আইসিউ রয়েছে। কিন্তু জনবলসংকটের কারণে এখনো ১৬ শয্যার আইসিউ চালু করা যায়নি। জনবলের চাহিদা দেওয়া আছে। বর্তমানে আমাদের আইসিউতে চিকিৎসক আছেন ১৪ জন।’