এক তরুণের উদ্যোগ, খাবার পেল হাজারজন

‘২০ হাজার মন্তব্য পড়লে মাথা ন্যাড়া করে ফেলব’—ফেসবুক খুললেই এখন দেখা মিলছে এমন হাস্যরসের আহ্বান। এতে সাড়াও পড়ছে বেশ। একই ফেসবুক ব্যবহার করে মু. রায়হান সোবহানও মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে তাঁর এই আহ্বানে মিশে আছে হাসির বদলে দুঃখের গল্প। তিনি কখনো হাজির হচ্ছেন এই আহ্বান নিয়ে—আপনারা চাল, ছোলা, পেঁয়াজ কিনে দিলে অসহায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। আবার কখনোবা কিছু টাকা হলেই এতিমদের খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে।

এই তরুণের নেওয়া এ উদ্যোগে এরই মধ্যেই খাবার জুটেছে হাজারো মানুষের। যত দিন না করোনাভাইরাস শেষ হচ্ছে, তত দিন তিনি অন্যদের সহায়তায় এই মানবিক কাজ চালিয়ে নিতে চান।

রায়হান সোবহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। পড়াশোনার ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে একটি আইন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালান। করোনাভাইরাসের কারণে চারপাশে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের হাহাকার শুরু হলে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের অধীনে গত ১ এপ্রিল খোলেন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট নামের একটি শাখা। তাঁর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন আরও ৩০ তরুণ-তরুণী।

গত এক মাসে এই তরুণেরা দেশের ৮ জেলায় ৮৬৩টি পরিবারের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য তুলে দিয়েছেন। অভাবে থাকা ৪০ জন ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে দিয়েছেন আর্থিক সাহায্য। রাতে ঘুরে ঘুরে ৫৫৫ জন ভাসমান মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন খাবার। এর বাইরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিলি এবং বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) কেনার জন্য দিয়েছেন আর্থিক সহায়তাও। পুরো বিষয়টি স্বচ্ছতার জন্য দিন শেষে হিসাব-নিকাশ তুলে দিচ্ছেন ফেসবুকের পাতায়।

রায়হান সোবহানের এমন মানবিক কাজের উৎপত্তি আসলে তাঁর মায়ের এক আহ্বান থেকে। মার্চ মাসের শেষের দিক। একদিন হঠাৎ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গ্রাম থেকে উদ্বেগ মেশানো গলায় মায়ের ফোন। ছেলেকে জানান, আশপাশের মানুষ খুব কষ্টে আছেন, খেয়ে–না খেয়ে দিন পার করছেন। সঙ্গে বলে দেন, এই দুঃসময়ে পারলে মানুষের জন্য কিছু কর। মায়ের সেই অনুরোধের পর নিজের জমানো টাকায় বেশ কিছু মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। তবে এই অল্পতে মন ভরছিল না তাঁর। তাই অনেকের কাছে সহায়তা চান। তবে সেভাবে সাড়া মিলছিল না। এরপরই ফেসবুকে ভিন্নভাবে আহ্বান শুরু করে দেন তিনি। আর এতেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই এগিয়ে আসেন। এ পর্যন্ত ১৪৪ জন মানুষ ও ৮টি প্রতিষ্ঠান এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। মূলত, সেই টাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন রায়হান সোবহান ও তাঁর দল।

সেই গল্প শোনাতে গিয়ে রায়হান বলেন, ‘আপনার দান, আমাদের বিতরণ—স্লোগানে ফেসবুকে সবাইকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। বড় ভাইবোনেরা এবং বন্ধুরা এভাবে এগিয়ে আসবেন আর এত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারব কল্পনাতেও ছিল না।’

রায়হান জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজ এলাকার গরিব মানুষের তালিকা করেন। সেই তালিকা অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে দেওয়ার জন্য বিকাশে তাঁদের টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, ভোলা, কুড়িগ্রাম ও খুলনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৮৬৩ পরিবার এই ত্রাণ পেয়েছে।

রায়হান সোবহানের এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তবে সেই বাহবাকে পাশ কাটিয়ে রায়হান সোবহান বলছেন, ‘মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এটাই তো সেরা সুযোগ। এখন তাঁদের জন্য কিছু না করলে কবে করব?’