জুলাইয়ে স্বাভাবিক জীবন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জুলাইয়ের শুরু থেকে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তখন মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। বিশেষজ্ঞরা একে বলছেন ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবন। এর আগ পর্যন্ত দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে।

দেশের আটজন জনস্বাস্থ্যবিদ করোনা সংক্রমণের পরিসমাপ্তি বিষয়ে এই সময়চিত্র (টাইমলাইন) দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, করোনা সংক্রমণের আগের দেশ ও সমাজ হয়তো নিকট ভবিষ্যতে ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে জুনের শেষ নাগাদ সংক্রমণ অনেক কমে আসতে পারে। হাসপাতালে রোগী ও মৃত্যু কমে আসতে পারে। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে গত শনিবার সকালে এই পূর্বাভাস বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উপস্থাপনা দেওয়া হয়। একাধিক বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশাব্যঞ্জক পূর্বাভাস আমরা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পেয়েছি। কিন্তু এটা ধারণা মাত্র। বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন। সর্বসাম্প্রতিক তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই প্রক্ষেপণ বা পূর্বাভাসে পরিবর্তনও আনতে পারেন।’

এ বছরের জানুয়ারিতে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথমে চীনের কয়েকটি প্রদেশে, তারপর চীনের প্রতিবেশী দু–একটি দেশে এবং পরে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে নানা ধরনের গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। তার ভিত্তিতে অনেক পূর্বাভাস শোনা গেছে জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকদের কাছ থেকে। এসব বিশ্লেষণের ফলাফল অনেক সময় হাসপাতাল তৈরি, জনবল নিয়োগ ও সরঞ্জাম জোগাড় করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এসব পূর্বাভাস অনেক দেশেই মেলেনি এমন নজিরও আছে।

>

করোনা সংক্রমণের পরিসমাপ্তি বিষয়ে দেশের আটজন জনস্বাস্থ্যবিদের পূর্বাভাস। এর আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি পুরোপুরি মানতে হবে।

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাসের বিষয়ে ওই আটজন বিশেষজ্ঞের বাইরে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, এই ধরনের প্রক্ষেপণে সাধারণত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া অনেক মৌলিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের দরকার হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার ঘাটতি আছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। প্রায় প্রতিটি দেশ অন্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ব্যবসা–বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। ৪৩ জেলা লকডাউন (অবরুদ্ধ)। স্কুল–কলেজ ছুটি। একই পরিবারের সদস্যরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন। কাজ নেই অনেকের। এরই মধ্যে নতুন সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। মানুষ জানতে চায়—এই দমবন্ধ পরিস্থিতি কবে শেষ হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটি সেই সময়ের একটি আভাস দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হবে জুনের শেষ নাগাদ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আমরাও বলতে চাই, এই ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ থাকার পূর্বাভাস দেওয়ার সময় এখনো আসেনি।’

অধ্যাপক শাহ মুনির ছাড়াও অন্যদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ দলে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরও একজন সাবেক মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করেন এমন একটি বিদেশি সংস্থার সাবেক প্রধান। ওই আটজন বিশেষজ্ঞ দেশের আট বিভাগের করোনা বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেন।

দেড় সপ্তাহ আগে এই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মে মাসের শেষ নাগাদ দেশে ৪৮ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। এই প্রক্ষেপণের ভিত্তি ছিল করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন দেশে বিস্তারের ধরন, বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার, জনমিতি, আবহাওয়া, সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ—এ রকম আরও বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশেষজ্ঞ দলের একজন প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ধরনের পূর্বাভাস বা প্রক্ষেপণের জন্য যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক তথ্য দরকার হয়, তা তাঁদের কাছে নেই। যেমন দেশের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব অনুযায়ী দিনে কমপক্ষে ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বর্তমানের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে ৬ হাজারের বেশি। তবে তাঁরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ছাড়াও অন্য গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রতিদিন সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন।

সময়চিত্র
বিশেষজ্ঞরা চারটি সময়কাল ধরে সরকারকে সতর্ক করেছেন। প্রায় প্রতিদিন শনাক্ত হওয়া রোগী বাড়তে পারে। এটা চলতে থাকবে ১৬, ১৭ ও ১৮ মে পর্যন্ত। সেটাই হবে ‘পিক’। তাঁরা পিকের তারিখ বলছেন ১৭ মে। এই পরিস্থিতি থাকতে পারে ঈদ পর্যন্ত।

ঈদের পর থেকে রোগের প্রাদুর্ভাব আস্তে আস্তে কমতে পারে। এটা এমন নয় যে হঠাৎ করে রোগী অনেক কমে যাবে। কোনো কোনো দিন রোগী বাড়তে পারে। তবে মূল প্রবণতা থাকবে কমে যাওয়ার দিকে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে ১০, ১১, ১২ জুন পর্যন্ত। ১১ জুন তারিখটাকেই ‘সময়চিহ্ন’ হিসেবে ব্যবহার করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারপর থেকে দৃশ্যমানভাবে রোগীর সংখ্যা কমতে পারে। ২৫ জুন পর্যন্ত গেলে আক্রান্ত মানুষ প্রায় শূন্যের কোঠায় দেখা যেতে পারে।

অনুমিত সময় অনুযায়ী, জুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত করোনার প্রকোপ থাকতে পারে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার ইঙ্গিত বা সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে জুলাইয়ের শুরু থেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু—এসব তথ্য নিয়মিত পর্যালোচনা করবেন। তাঁদের পূর্বাভাসের পরিবর্তনের বিষয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানাবেন।

বিষয়টি সহজ নয়
আটজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এখন থেকেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, দেশের প্রত্যেক মানুষের মাস্ক ব্যবহার এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার বিষয়টি অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

স্বাস্থ্য বিভাগ সন্দেহভাজন ব্যক্তি বাছাই, শনাক্ত ও শনাক্ত রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা দেবে। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা এসেছিল, তাদের খুঁজে বের করাও অব্যাহত রাখবে।

লকডাউনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, কোনো জেলায় ১০০ রোগী থাকলে সেই জেলা লকডাউন করতে হবে। আর কোনো শহরের বা গ্রামে ১০ জন রোগী থাকলে সেই এলাকা লকডাউন করতে হবে। তাঁরা এসব উদ্যোগকে বলছেন কৌশলগত শিথিলতা।

বিশেষজ্ঞদের একজন প্রথম আলোকে বলেছেন, আপনা–আপনি রোগ কমবে না। সংক্রমণ বাধাগ্রস্ত করতে পারলে রোগ কমবে। এর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বিশেষজ্ঞ দলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রক্ষেপণ তৈরি বা পূর্বাভাসের কাজের সময় ঈদের সময়কার সামাজিক মেলামেশার বিষয়টি তাঁরা হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিকের কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়টি তাঁদের হিসাবে ছিল না।

প্রস্তুতি বা সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি আছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে গেলে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও ভালো প্রস্তুতি সরকারের আছে।’

গত বর্ষা বা শীত যেমন ছিল, তা আর কোনো দিন আসবে না। প্রাদুর্ভাব কমে এলেও সংক্রমণ হয়তো শনাক্ত হবে না, তবে ভাইরাসটি থেকে যাবে কোনো না কোনো মানুষের শরীরে। ভয় সেখানেই। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আগের মতো স্বাভাবিক আর হবে না বলেই ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থায় চলতে হবে সবাইকে।