কোথাও কি কেউ আছে

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

চাকরিসূত্রে স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে নিয়ে ঢাকায় আছি। ঢাকায় আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। কিন্তু ২৫ বছরের ঢাকা–জীবনে আত্মীয়স্বজনের অভাব এত তীব্রভাবে কখনো অনুভব করিনি। খবরে পড়ি, আক্রান্ত মাকে পথে ফেলে দিচ্ছে সন্তানেরা, করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকার হচ্ছে না, আত্মীয়স্বজন কাছে ভিড়ছে না। তবু এই ঘোর বিপদের সময়ে তাদেরই আশেপাশে থাকতে মন চায়। কাছে কেউ না আসুক, তবু চৌহদ্দির মধ্যে নিকটজন আছে, এই চিন্তাটাই খুব স্বস্তি দেয়। মনে ভরসা জোগায়। এই স্বস্তি এখন লাখ টাকার চেয়েও দামি।

অবরুদ্ধ ঢাকায় বিপদে পড়ে গেলে পাশে থাকার কেউ নেই, এই দুশ্চিন্তাই বিরাট হতাশা আর অবসাদ নিয়ে আসছে মনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এয়ারপোর্টে ডিউটিতে যেতে হচ্ছে। এখন আমার মধ্যেই যদি করোনার উপসর্গ দেখা দেয়, দু–একজন প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব যাঁরা আছেন, তাঁরাও দূরে সরে যাবেন। তখন কে দেখবে আমার অসহায় স্ত্রী-পুত্রকে?

এসব নিয়ে যখন নানা দুর্ভাবনায় আছি, তখন রংপুর থেকে ছোট ভাই ফোন দিল। ফোনে জানাল, টেস্টে বড় ভাইয়ের করোনা পজিটিভ এসেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অশীতিপর বাবা আর এই বড় ভাই ছাড়া তিন কুলে আমাদের চার ভাই আর এক বোনের আর কোনো অভিভাবক নেই। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। এ অবস্থায় রংপুরে যাওয়াও অসম্ভব। ভাবির কান্না থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। ভাই–ভাবি দুজনই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সিং সুপারভাইজার। ভাইয়ের করোনা সংক্রমণ সম্ভবত হাসপাতাল থেকেই হয়ে থাকবে।

ভেবে কোনো দিশা পেলাম না। ছোট ছোট তিনটি ভাতিজা আমার। সবার ছোটজন জন্মের পর থেকে থ্যালাসেমিয়ার রোগী। দুই মাস পরপর রক্ত দিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই ওর শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি কম। আল্লাহ না করুক, ও যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যায়? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না।

শুনতে পেলাম, গতকাল সন্ধ্যাবেলাতেই ভাইকে রংপুরের একমাত্র ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পরিহাস হলো, এই হাসপাতালটিকে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে মাত্র কিছু দিন আগে আমার বড় ভাই–ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সশরীরে উপস্থিত থেকে তদারকি করেছে। এখন সেখানে একটি কোণে নিঃসঙ্গ বিছানায় শুয়ে তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে নিঃসঙ্গতম ভয়ংকর সময়টি পার করছে। তার মাথায় পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা, তার থ্যালাসেমিয়ার রোগী ছোট সন্তানের জন্য দুর্ভাবনা। সাড়ে তিন শ মাইল দূরে বসে থেকে অক্ষম আমি দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না।

সকালে ফোন দিয়েছিলাম ভাইকে। পৌনে ৯টা পর্যন্ত সে অভুক্ত। ওয়ার্ডের ইনচার্জ তারই সহপাঠী। ফোন না করে নাশতার জন্য সে এসএমএস পাঠিয়েছে। ভেবেছে, বন্ধু হয়তো ঘুমাচ্ছে। ফোন করলে ঘুমের ব্যাঘাত হবে। এমনই নিরীহ আমার বড় ভাই।

আমার ছাত্রাবস্থায় একবার সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার হলে এসেছিল। সন্ধ্যাবেলায় দেখি, বাথরুম থেকে ভিজে একসা হয়ে রুমে এসেছে। বললাম, ‘ভাই, ভিজলি কী করে?’ জবাব দিল, ‘একটা বাথরুমের ট্যাপ খুলে গিয়ে পানি পড়ছিল। ওটা বেঁধে দিলাম।’ অথচ আমাদের ওই হলের ছাত্রদের চোখের সামনে দিনের পর দিন ভাঙা ট্যাপ দিয়ে অঝোরধারায় পানি পড়ছে। আমরা কেউ মোটেই গা করিনি।

গত বছর ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে ভাই এসেছিল হজক্যাম্পে। সারি সারি কক্ষের ঠিক কোনটিতে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে, জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ প্রতিটি কক্ষের দরজা ছিল একবারে হাট করে খোলা। সেগুলোর কোনো একটাতে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেই তথ্যটি জেনে যাওয়া যায়। কক্ষের বাইরে ভাই আধা ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করল। শেষে আমিই একটা কক্ষে ওকে জোর করে নিয়ে গেলাম।

আব্বা তো বলতে গেলে এখন অচল। ত্রিভুবনে এই ভাই–ই আমাদের সব। দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুম হয়নি। আল্লাহ হয়তো আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন।