মানুষের জন্য ছুটছে 'কলের গাড়ি'

'খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। আমার বাচ্চা সবসময় হরলিকস খায়, সেটা কিনে দিতে পারছি না। এর চেয়ে হতভাগ্য বাবা আর কে হতে পারে? এই মুহূর্তে আমার কাছে কোনো টাকা নেই। খাবারও শেষ। কারও কাছে হাতও পাততে পারি না। আপনারা বলেছেন, যাঁদের খাদ্যসহায়তা করবেন, তাঁদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করবেন না। আমি আপনাদের কাছে সাহায্যপ্রার্থী। প্লিজ, আমাকে এই অসহায়ত্ব থেকে বাঁচান।'

এটি মুঠোফোনে পাঠানো এক খুদেবার্তা। পাঠিয়েছেন করোনাভাইরাসের কারণে আয়হীন হয়ে বিপাকে পড়া নগরের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক ব্যক্তি।

 দুপুরে ওই ব্যক্তির বার্তা পেয়ে রাতে তাঁর হাতে গোপনে খাবারের সামগ্রী তুলে দেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। এ রকম প্রতিদিন মুঠোফোনে কল আর খুদেবার্তায় শত অভাব-অনটনের গল্পের তাঁরা মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানালেন। খবর পেয়েই তাঁরা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে চলছেন সেসব পরিবারের কাছে। টানা ৪১ দিন ধরে যৌথভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিলেটের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ। কল করা মাত্রই ছুটে যাওয়ার কারণে পুরো কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে 'কলের গাড়ি'।

 সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিলেট নগর ও শহরতলির শ্রমিক-দিনমজুর, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ বিপাকে পড়া যেকোনো বাসিন্দা ০১৭২৯২০০৯৮৪ নম্বরে প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে তিনটা পর্যন্ত কল করে বা খুদেবার্তা পাঠিয়ে খাদ্য সহায়তা চাইতে পারবেন। তবে পুরো বিষয়টিই গোপন রাখা হবে। তিনটার পর থেকে সুবিধাভোগীদের সময় অনুযায়ী মধ্যরাত পর্যন্ত চারটি গাড়ি ও ১০টি মোটরসাইকেলে করে খাদ্যসামগ্রী নির্দিষ্ট বাসা-বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল রোববার পর্যন্ত প্রায় ছয়হাজার মানুষকে আনুমাণিক ৩০ লাখ টাকার খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে নগরের রিকাবিবাজার এলাকার কবি নজরুল অডিটোরিয়াম থেকে।

 সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত জানান, খাদ্যসামগ্রীর প্রতিটি প্যাকেটে রয়েছে পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি ছোলা ও এক কেজি মসুর ডাল। ক্ষেত্র বিশেষে সাবানও দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২২ রমজান থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এসব খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি লাচ্ছা সেমাই, চিনি ও দুধ উপহার হিসেবে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ঈদের দিন নিজেদের বাসা ফেলে বাইরে জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হাতে রান্না করা সেমাই ও পিঠা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তুলে দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ৬০ জন সংস্কৃতিকর্মী প্রতিদিন খাদ্যসামগ্রী কেনা ও প্যাকেটজাত করা থেকে শুরু করে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন। পুরো কাজ সমন্বয় করছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সদস্য শামসুল আলম সেলিম, সিলেটের সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন ও সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী এবং সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত। প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের তহবিলে আর্থিক সহায়তা করছেন। এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও তাদের মাটির ব্যাংকে জমানো পয়সা তুলে দিচ্ছে। তবে আগ্রহী যে কেউ ০১৭১১৪৬৯৭১৫ (ব্যক্তিগত) নম্বরে বিকাশ করে এ আয়োজনে সম্পৃক্ত হতে পারেন।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী বলেন, 'অসংখ্য ফোনকলের সঙ্গে খুদেবার্তাও আসে। এসব পড়ে আমরা প্রতিদিন আবেগতাড়িত হই, চোখের পানি ফেলি। খাবারের সংকটে থাকা মধ্যবিত্ত মানুষজন লজ্জা-সংকোচবোধে শুরুতে সাহায্য চাইতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। পরে যখন বুঝতে পারেন, আমরা বিষয়টি গোপন রাখব, তখন তাঁরা অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন। আমরা গোপনে চোখের পানি ফেলি আর নীরবে রাতের আঁধারে গিয়ে সাধ্য অনুযায়ী খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিই। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতেই সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।'

'কলের গাড়ি'র সঙ্গে যুক্তদের সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ মার্চ থেকে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ খাদ্যসামগ্রী ও আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ করে। এরপর ১ এপ্রিল থেকে বিপাকে পড়া মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান শুরু করে। ৩ এপ্রিল থেকে তারা হটলাইন চালু করে। যে কেউ নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারবে। এ আয়োজনে ১৪ এপ্রিল এসে যুক্ত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এরপর থেকে যৌথভাবেই সিলেটের নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা এ কর্মসূচি টানা পালন করে আসছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ অনেকেই তাঁদের সহায়তা করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন কোনো ধরনের ভাড়া ছাড়াই এ কাজের জন্য কবি নজরুল অডিটোরিয়ামটি তাঁদের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী বলেন, 'কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের যে মঞ্চে আমরা মানবতার উৎকর্ষ সাধনে গান-নৃত্য-আবৃত্তি-নাটকে মেতে উঠতাম, এখন সেই মঞ্চে প্রতিদিন মানবতার কল্যাণেই খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটজাত হচ্ছে। এ দুঃসময়ে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।'