করোনায় 'মডেল কেরানীগঞ্জ', বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা

বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গত রোববার সকালে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ছাটগাঁও এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গত রোববার সকালে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ছাটগাঁও এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা ছাটগাঁও এলাকার বাসিন্দা সুলতান মিয়া। তিনিসহ তাঁর পরিবারের তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তাঁরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা দু-এক দিন পরপর তাঁদের বাসায় যাচ্ছেন। পাশাপাশি মুঠোফোনে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

কেরানীগঞ্জ উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে ৩০০ ছাড়িয়েছে। একক উপজেলা হিসেবে এখানেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের কয়েকটি জেলা ছাড়া বেশির ভাগ জেলায়ও এত বিপুলসংখ্যক রোগী নেই। করোনা-ভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল নারায়ণগঞ্জের পাশের এই উপজেলায় সীমিত সম্পদ দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে সেখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবায়। মোট আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে নিজ নিজ বাসায় রেখে।

বাসায় রেখে করোনা রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের ৫টি দলে এবং স্বাস্থ্য সহকারী ও সহকারী পরিদর্শকদের ১২টি দলে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করছে এই দলগুলো। চিকিৎসকদের ৫টি দলের মধ্যে ৩টি দল কাজ করছে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে। প্রতিটি দলে আছেন ৩ জন করে চিকিৎসক। চিকিৎসকদের প্রতিটি দলের অধীনে ৪টি করে মোট ১২টি দল আছে স্বাস্থ্য সহকারী ও সহকারী পরিদর্শকদের। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে এই ১২টি দল কাজ করে।

চিকিৎসকেরা ফোনে রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সহকারীদের মাধ্যমে খবরাখবর নেওয়া ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ার কাজ করেন। প্রয়োজন হলে তাঁরা রোগীদের বাড়িতে যান। আর স্বাস্থ্যকর্মীদের দল এক দিন পরপর রোগীদের বাড়ি যান।

তাঁদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার পাশাপাশি খোঁজখবর নেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শ পৌঁছে দেন। এ ছাড়া দুজন চিকিৎসকের একটি দল কাজ করে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে, আরেকটি দলে থাকা দুজন চিকিৎসক কাজ করেন সুস্থ হয়ে ওঠার পর্যায়ে থাকা রোগীদের নিয়ে।

করোনায় আক্রান্ত কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা সুলতান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। দু-এক দিন পরপর বাসায় স্বাস্থ্যকর্মীরা দেখতে আসেন। তাঁরা প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য দিয়ে যান। এ ছাড়া এলাকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন এসে বাসায় খাবার পৌঁছে দেন।

কেরানীগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যার। এখানে ৬টি আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন রাখা) শয্যা আছে। এ ছাড়া আছে ২০ শয্যাবিশিষ্ট জিনজিরা হাসপাতাল। হাসপাতালটি শুধু কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে ভর্তি আছেন ১৬ জন। জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় ৪টি শয্যা ফাঁকা রাখা হয়েছে। এর বাইরে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে কেরানীগঞ্জের অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মীর মোবারক হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সীমান্তবর্তী হওয়ায় কেরানীগঞ্জে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করছেন। আর শুরু থেকে পরীক্ষার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। দেড় শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে। বাসায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আলাদা আলাদা দল কাজ করে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা মূলত ফোনে সেবা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। চিকিৎসার বাইরে খাবার বা অন্য কোনো সমস্যার কথা জানা গেলে তা উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়। উপজেলা প্রশাসন সার্বিক সহায়তা দেয়।

এই উপজেলায় শুরু থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের ওপর জোর দেওয়া হয়। শিক্ষক, কৃষি বিভাগের কর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সমন্বয়ে দল গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সন্দেহভাজন রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন। পরবর্তী সময়ে দুটি হটলাইন নম্বরও চালু করা হয়। রোগী শনাক্তের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা মিলে লকডাউন (অবরুদ্ধ) করে দিতেন। তবে এখন রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মীর মোবারক হোসাইন।

এখন পর্যন্ত কেরানীগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০৭। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০৪ জন আক্রান্ত জিনজিরা ইউনিয়নে। এ ছাড়া তেঘরিয়া ইউনিয়নে ৬৩ জন, শুভাঢ্যা ইউনিয়নে ৫৫ জন আক্রান্ত আছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩ জন চিকিৎসক, ২২ জন স্বাস্থ্যকর্মী, ৪১ জন পুলিশ সদস্য, ২০ জন র‌্যাব সদস্যও আছেন।

জিনজিরা ইউনিয়নে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মী দলের প্রধান সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক (এএইচআই) সালমা জাসমিন। তাঁর দলে আরও তিনজন সহকারী পরিদর্শক কাজ করছেন। সালমা জাসমিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতিদিন নিয়ম করে রোগীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। এক দিন পরপর সশরীরে রোগীদের বাড়ি বাড়ি যান, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শ দেন।