বাড়িতে করোনা রোগীর চিকিৎসা বড় চ্যালেঞ্জ

বাড়িতে করোনায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। সব রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণের এই পর্যায়ে রোগী বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

কারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা কীভাবে করাবেন, রোগ নিরাময় হচ্ছে কি না কীভাবে বুঝবেন, রোগ নিরাময়ের সনদ কীভাবে, কার কাছ থেকে জোগাড় করবেন, প্রয়োজনে কখন ও কীভাবে হাসপাতালে যাবেন—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন না। হাসপাতালের প্রস্তুতি, রোগী ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা ও পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। কিন্তু বাড়িতে থাকা রোগীর বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য কেউ দিচ্ছেন না। অথচ হাসপাতালের চেয়ে বাড়িতে করোনা রোগী প্রায় চার গুণ বেশি। মূলত টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সরকার বাড়িতে রোগীর সেবা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

গত পরশু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৯ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করানো হয়। গতকাল বুধবার তিনি মুঠোফোনে বার্তা পান যে তিনি করোনায় আক্রান্ত। তিনি ভর্তির জন্য সরকার নির্ধারিত একটি হাসপাতালে যান। কর্তৃপক্ষ বলেছে, শয্যা খালি নেই। এরপর তিনি আইইডিসিআরে যোগাযোগ করেন। আইইডিসিআর তাঁকে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন। পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় আছেন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। 

>

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে
বাড়িতে থাকা রোগীদের বিষয়ে আলোচনা কম, সমস্যা বেশি

এ রকম অনেক ঘটনা জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে সেবা না পেয়ে মানুষ সহায়তা পেতে গণমাধ্যমে ফোন করছেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর জিগাতলা এলাকার এক বাসিন্দা ফোন করে জানতে চান, তাঁর ছেলেকে বাড়িতে রেখে কীভাবে চিকিৎসা দেবেন? ২৪ বছরের ছেলেকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে চান না।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ানস অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আজিজুল কাহ্‌হার প্রথম আলোকে বলেন, রোগের উপসর্গ যাঁদের মৃদু, তাঁদের টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে টেলিমেডিসিন সেবা
থাকতে হবে। যাঁরা সেবা দেবেন, তাঁদের টেলিমেডিসিনের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে, করোনা চিকিৎসারও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

কে নেবে সিদ্ধান্ত

কোন রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নেবেন, আর কে হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন—এই সিদ্ধান্ত কে নেবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সরকার বলছে, মৃদু উপসর্গ থাকলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার দরকার নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) আমিনুল হাসান। তিনি বলেন, যাঁদের কোনো রকম লক্ষণ নেই, অথচ রোগ শনাক্ত হয়েছে, তাঁরা বাড়িতে থাকবেন। যাঁদের সামান্য জ্বর, সামান্য কাশি, সামান্য গলাব্যথা, তাঁরাও বাড়িতে থাকবেন।

রোগ শনাক্তকরণের পর তথ্য জানানোর কাজের পুরোটাই হচ্ছে যান্ত্রিকভাবে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও বুথ থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন টেকনোলজিস্টরা। পরীক্ষা শেষে মুঠোফোনের মাধ্যমে বা খুদে বার্তার মাধ্যমে বা ই–মেইলের মাধ্যমে ফলাফল জানানো হচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জেনে অনেকে আতঙ্কিত হচ্ছেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

সারা বিশ্বের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা গেছে বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশে কত মানুষ মৃদু উপসর্গ নিয়ে ভুগছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে অধ্যাপক আজিজুল কাহার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আমিনুল হাসান দুজনই বলেছেন, মাঝারি মাত্রার উপসর্গ দেখা দিলেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

কত রোগী বাড়িতে

গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮২২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩ হাজার ৩৬১ জন ও মারা গেছেন ২৬৯ জন।

ঢাকা শহর এবং ঢাকা বিভাগসহ আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩ হাজারের কিছু বেশি রোগী। অর্থাৎ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১০ হাজারের বেশি রোগী।

বাড়ির সেবা কেন চ্যালেঞ্জ

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী সেবার আওতায় আছেন। বাড়িতে থাকা রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা টেলিমেডিসিনের সেবার আওতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’

অর্থাৎ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত মানুষ সরকারি চিকিৎসাসেবার বাইরে রয়ে গেছেন। এই হার প্রতিদিন বাড়ছে। প্রতিদিন সুস্থ হওয়ার চেয়ে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ এক দিনে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৬২। আর হাসপাতাল ছেড়েছেন ২১৪ জন।

সুস্থ ও শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যার পার্থক্যের বাইরে অন্য সমস্যাও আছে। অধ্যাপক আজিজুল কাহার বলেন, একজন রোগী সন্ধ্যায় হয়তো ভালো ছিলেন, গভীর রাতে তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। তখনই তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এই ব্যবস্থাগুলো থাকতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গভীর রাতে সমস্যা জানানোর নির্দিষ্ট স্থান থাকতে হবে, দ্রুততম সময়ে যেন অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে, কোন হাসপাতালে পৌঁছালে নিশ্চিত সেবা পাওয়া যাবে, তা জানারও ব্যবস্থা থাকতে হবে।

নিরাময়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া নিয়েও জটিলতা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর উপসর্গ না থাকলে ধরে নেওয়া হয় যে রোগী সুস্থ হয়েছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। শনাক্ত হওয়ার পর ১৪ দিনের বেশি বাসাতেই ছিলেন। ১১ মে টেলিমেডিসিনের চিকিৎসকেরা তাঁকে সুস্থ বলেছেন। কিন্তু বাড়ির মালিক তাঁকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। বাড়ির মালিক বলেছেন, সাংবাদিক যে করোনাভাইরাসমুক্ত, এই বিষয়ে পরীক্ষার সনদ লাগবে। আবার ঢাকা শহরে একটি বাড়িতে রোগ শনাক্ত হওয়ার পর ওই এলাকাটি লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়েছিল। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু সবাই সুস্থ হওয়ার পরও এলাকায় লকডাউন তোলেনি পুলিশ।

আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘এ রকম নানা সমস্যার কথা আমরা নিয়মিত শুনছি। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই পরীক্ষার মাধ্যমে না গিয়ে অন্য কী উপায়ে সমস্যা সমাধান করা যায়, আমরা তা নিয়ে কাজ করছি। এখন আমরা সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের সঙ্গে কথা বলি। পুলিশ তখন বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে বা লকডাউন তুলে নেয়।’

সেবা কে দিচ্ছে

শুরুর দিকে শুধু আইইডিসিআরের চিকিৎসকেরা বাড়িতে থাকা করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। মানুষ ফোন করে সেবার বিষয়ে জেনে নিতেন। আবার নিয়মিত বিরতিতে আইইডিসিআরের চিকিৎসকেরাও ফোন করতেন রোগীকে। রোগী বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সেবা কমে এসেছে, যদিও এখনো তা বন্ধ হয়নি।

এরপর এই সেবায় ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ নম্বর’ যুক্ত হয়। তবে স্বাস্থ্য বাতায়ন থেকে রোগীর ফলোআপ করা হয় না বলে জানা গেছে। কোনো রোগী ফোন করলে কল সেন্টারে থাকা চিকিৎসকেরা তাঁকে পরামর্শ দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সংশ্লিষ্ট এলাকার রোগীকে নিয়মিত ফোন দেয়। ঢাকার কেরানীগঞ্জে উপজেলার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বাড়ি গিয়ে সেবা দিচ্ছেন—এই সংবাদও বেরিয়েছে। এ ছাড়া মেডিসিন ক্লাবসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রোগীদের সেবা দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল বলেছেন, বাড়িতে থাকা রোগীদের চিকিৎসার জন্য টেলিমেডিসিনের আওতা বাড়ানো, বেশি মানুষকে সেবার আওতায় আনতে দুই দিন আগে সভা হয়েছে। অধিদপ্তরের পরিচালক আমিনুল হাসান বলেন, এটুআই, স্বাস্থ্য বাতায়ন, উবার ডাক্তার—সবাইকে নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই তার বাস্তবায়ন শুরু হবে।