আজকালকার আমি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ অনেক দিন হয়ে গেল। ঢাকা থেকে যখন ফিরছিলাম, তখনো বুঝতে পারিনি এত দিন থাকা লাগবে। আসলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা খুব একটা ঠাহর করতে পারিনি সে সময়। হাতের কাছে যা পেলাম কাপড়চোপড়, তাই ব্যাগে ভরে নিয়ে এলাম। দুই সপ্তাহ পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ফেললে টানা পরীক্ষার চাপ পড়ে যাবে—এই ভেবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটস নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কে জানত! এই দুই সপ্তাহ এত দিন পর্যন্ত গড়াবে। 

ও আচ্ছা, বলাই হয়নি। আমি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছি। ঢাকায় ব্যাচেলর মেসে থাকি। আর আমার বাসা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সত্যি বলতে এতটা সময় পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সুযোগটা খুব কম হয়। আমাদের সেমিস্টার ব্রেকও এতটা লম্বা হয় না। অনেক দিন পর এতটা সময় নিয়ে বাসায় থাকা।

সময় কাটছে না বললে ভুল হবে। বেশ ভালোভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে। বাগানের গাছগুলোর যত্ন করছি নিয়মিত। সেদিন সকালে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার লাগানো গাছটায় তিন রঙের ভিন্ন ভিন্ন তিনটি ফুল ফুটল। এত ভালো লাগল যে বলার মতো নয়। কি মনে করে সেদিন স্টোররুমে ঢুকে দেখি, পুরোনো একটা জং ধরা হারিকেন বাতি। বেচারাকে দেখে খারাপ লাগল বেশ, বসে গেলাম রংতুলি নিয়ে। অদক্ষ হাতের সর্বোচ্চ চেষ্টায় এটাকে খানিকটা নতুন রূপ দিলাম। আম্মু তো খুশি হয়ে ওটাকে শো কর্নারে সাজিয়ে রাখল। ভালোই প্রমোশন হয়েছে ওটার। স্টোররুম থেকে ডিরেক্ট শো কর্নার। সেদিন পুরোনো অ্যালবামগুলো বের করে সবাই মিলে খুব স্মৃতিচারণা করছিলাম।সত্যি! সময় কি দ্রুত বদলে যায়। ছবির পেছনের একেকটা মজার গল্পের কথা মনে করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলাম একেকজন। তবে একেবারেই যে শুয়েবসে সময় কাটাচ্ছি তা কিন্তু নয়। ঘরে বসে বসে কিছু অনলাইন কোর্স করছি। ক্লাস খোলা থাকলে তো এগুলো করার সুযোগ হয়ে ওঠে না।

দিনের সবচেয়ে প্রিয় সময়টা হচ্ছে শেষ বিকেল। প্রতিদিনের বিকেলটা এখন ছাদে কাটছে। পাল্লা দিয়ে অই আকাশটায় ঘুড়ি উড়াচ্ছে আশপাশের বেশ কটা ছাদ থেকে। আহা! কত দিন এভাবে আকাশ দেখি না। পাখির কিচিরমিচির, ছাদের ধার ঘেষে বেড়ে ওঠা গাছগুলোর শুকনো পাতার শব্দ, রক্তিম আকাশ—সব মিলিয়ে গল্পস্রোতে সন্ধ্যা নামাচ্ছি আজকাল। ঢাকায় তো ব্যস্ততার কারণে কখন বেলা পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়ায়, টেরই পাওয়া যায় না। সেদিন পূর্ণিমার চাঁদটার দিকে এতটা অবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম যে বলার মতো নয়। আম্মু হেসে বলছিল, ‘কিরে? আর কখনো চাঁদ দেখিস নি নাকি।’ আম্মুকে কে বোঝাবে মফস্বল শহরের এই বিস্তৃত আকাশটা যে ঢাকার অই ধূসর আকাশের চেয়ে অনেক বেশি আপন। তবে আম্মু একদিক দিয়ে খুব খুশি। তার ছেলে যে এত বছর পর রোজায় বাসায় থাকছে এ কারণে। নরমালি এই সময়টায় আমার ক্লাস চলে কি না এ কারণে। ঢাকায় কি খাচ্ছি না খাচ্ছি, ঠিকমতো ইফতার–সাহ্‌রি করছি কি না—এসব নিয়ে প্রতিবছর মায়ের চিন্তার অন্ত থাকত না। এ বছর অন্তত তাকে এই টেনশন থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি।

তবে এত কিছুর মধ্যেও দিনশেষে দীর্ঘশ্বাসের মন খারাপেরা পাড়ি জমাচ্ছে। মনখারাপটা যতটা না নিজেদের জন্য, তার চেয়ে বেশি গরিব মানুষগুলোর জন্য। আমরা তো তাও দুবেলা দুমুঠো খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু যারা দিনে এনে দিনে খায়, তাদের তো আর বাসায় বসে থাকার উপায় নেই। ঢাকা থেকে যেদিন ফিরছিলাম, সেদিন দেখি রাস্তা মোড়ে মামা পেয়ারা নিয়ে গোমড়া মুখে বসে আছে। সকাল থেকে তার নাকি একটা পেয়ারা ভর্তাও বিক্রি হয়নি। হবে কি করে! মানুষের আনাগোনাই তো নেই। গৃহকর্মীকে বাবা আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এপ্রিল মাসের বেতন তাকে দিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর সব মানুষ যদি আমার বাবার মতো হতো! বাবার মতো হতে পেরেছি কি না জানি না! কিন্তু সেদিন এক সংগঠনকে কিছু টাকা পাঠালাম বিকাশে। গরিবদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করছেন তারা। খুব বেশি দিতে পারিনি, আসলে বাসায় থাকি বলে এখন আর হাতখরচের টাকার দরকার পড়ে না। তবে যে যেভাবে যতটুকু পারি, এই মানুষগুলোর সাহায্যে এগিয়ে এলে অন্তত এরা না খেয়ে থাকবে না। প্রতিদিন নামাজ পড়ে এই মানুষগুলোর জন্য দোয়া করছি।

এসব ভেবে মন খারাপ করে সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি হাড় জিরজিরে এক কুকুর হেঁটে যাচ্ছে। চটজলদি একটা পাউরুটি এনে ওটার দিকে ছুড়ে দিলাম। কুকুরটাকে দেখে আরও বেশি মন খারাপ হয়ে গেল। এরা তো ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খায়। কিন্তু যেখানে রেস্টুরেন্টগুলো সব বন্ধ, মানুষের আনাগোনা নেই। সেখানে ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাবার আসবে কোত্থেকে? মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে অন্তত বলতে পারব, ‘ক্ষুধা লেগেছ, খাবার দাও।’ কিন্তু এই প্রাণীগুলোর তো সেই সুযোগটিও নেই। ছোট্ট একটা ভাইরাস কি দ্রুতই না বদলে দিল পুরো পৃথিবীকে। যেন একটা দুঃস্বপ্ন। যেন এখনই ক্লান্ত দুপুরের অস্বস্তিকর ঘুমটা ভাঙবে, আর আমি মুচকি হেসে ভাবব, ‘কই, কিছু হয়নি তো! সবকিছু তো আগের মতোই আছে।’


*লেখক: শিক্ষার্থী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া। [email protected]