করোনার ধাক্কা সামলাতে ১৫ হাজার কোটি টাকা চায় বিদ্যুৎ বিভাগ

কোভিড-১৯ বা নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ কলকারখানায় বিদ্যুতের চাহিদা নেই। অন্যদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায় থমকে আছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই খাতে ঘাটতি হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর নাগাদ তা ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।

এই ঘাটতি দূর করতে আপাতত বিনা সুদে ১৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে ঋণ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

দেশে বর্তমানে আবাসিক আর শিল্প খাত ও অফিস-আদালতসহ বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে ৩ কোটি ৬৫ লাখ। গত অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, মাসে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আসে বিল বাবদ।

করোনার কারণে বিদ্যুৎ খাতের ক্ষতির হিসাব করেছে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। ক্ষতির প্রতিবেদনটি শিগগির প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে। সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) ক্ষতি হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে ৯ মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) ক্ষতি দাঁড়াবে ৩৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি।

মোহাম্মদ হোসেইন বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার বড় অংশ এখন অলস বসে আছে। কারণ, করোনাভাইরাসের জন্য কলকারখানা বন্ধ থাকায় চাহিদা নেই। কিন্তু সরকারকে বেসরকারি উৎপাদকদের কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে। বিদ্যুতের বিল আদায় বন্ধ থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আবার সঞ্চালন খাতও অলস বসে আছে। সব দিকের ক্ষতি সামলাতে সরকারের কাছে বিনা সুদে ঋণ-সহায়তা চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঋণের অর্থ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিসহ (ডিপিডিসি) ছয়টি বিতরণ সংস্থাকে দেওয়া হবে। এখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) এবং বিদ্যুতের সঞ্চালনের জন্য গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশকেও (পিজিসিবি) টাকা দেওয়া হবে।

আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পাওয়ার সেলের প্রতিবেদনটি ঋণ ছাড়া আরও চারটি সুবিধার সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) দেওয়া সরকারের ভর্তুকি অব্যাহত রাখা; সেচের জন্য কৃষককে প্রদেয় ভর্তুকির টাকা কৃষি মন্ত্রণালয়কে না দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া; বিদ্যুৎ বিভাগের সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখা; এবং বিদ্যুৎ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের বরাদ্দ ও অর্থ ছাড় অব্যাহত রাখা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুতের স্বাভাবিক চাহিদা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। ফলে অন্তত ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করা হচ্ছে। এর পুরোটাই বেসরকারি কোম্পানির। বসিয়ে রাখা এসব কোম্পানির কেন্দ্রভাড়া বাবদ সরকারকে প্রতি মাসে ৬২২ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। এপ্রিল থেকে জুনের তিন মাসে শুধু এই ভাড়া বাবদই যাবে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। আর কেন্দ্রগুলোকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে হলে এই গচ্চা দাঁড়াবে ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এবং মানুষের আর্থিক দুর্গতির কারণে বিদ্যুৎ বিল নেওয়া বন্ধ রয়েছে। যদি জুনের মধ্যে করোনাভাইরাস চলেও যায়, সব গ্রাহক তখনই বকেয়া বিল দিতে পারবেন না। পুরো ব্যবস্থা ঠিক হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যাবে। আর করোনার প্রাদুর্ভাব আরও বেশি দিন স্থায়ী হলে, বিদ্যুতের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের বিল বকেয়া পড়ছে। তারা আবার ব্যাংকের ঋণ নিয়েছে, সেখানে তাদের কিস্তি বকেয়া পড়ছে। সরকারি কেন্দ্রগুলোও জ্বালানির দাম দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত একটা বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্যই তাঁরা বিনা সুদে ঋণ চাইবেন।

দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা এককভাবে কিনে নেয় পিডিবি। তারপর পিডিবি তা দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ওই সংস্থাগুলো আবার সারা দেশের গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সংস্থাগুলো প্রতি মাসে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা বিলের অর্থ পিডিবির কাছে জমা দেয়। সেই টাকা থেকে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর পাওনা মেটানো হয়।

রাজধানীর উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করে ডেসকো। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাউসার আমীর আলী প্রথম আলোকে বলেন, কলকারখানা ও বাণিজ্যিক অফিস বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা সাংঘাতিকভাবে নেমে গেছে। গ্রাহকেরা যতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, তার বিল দিতে পারছেন না। গত মার্চ মাসে বিদ্যুৎ বিল ছিল ৩০০ কোটি টাকার মতো। প্রিপেইড মিটার থেকে এসেছে মাত্র ৮৮ কোটি টাকা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (ভাইস চ্যান্সেলর) অধ্যাপক ড. ম তামিম সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক সহকারী ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগ যে অর্থ চেয়েছে, তা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এই সময় মানুষ বিদ্যুতের বিল দিতে পারছে না। সরকার বিদ্যুৎ বিভাগকে টাকাটা দিলে জনগণই তার সুবিধা পাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে টাকাটা বিদ্যুৎ বিভাগকে অবশ্যই ফেরত দিতে হবে।