দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিলেন তাঁরা

এ যেন দুর্গম গিরি, কান্তার মরু পথ পাড়ি দেওয়া। ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ৫০০ মানুষের জন্য সরকারি ত্রাণ পৌঁছে দিলেন দুর্গম একটি জনপদে। এতে হাসি ফুটল করোনাকালে খেয়ে না খেয়ে থাকা এসব পরিবারের ছোট ছোট শিশুদের মুখে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত এই এলাকার নাম নাড়াইছড়ি। দীঘিনালা থেকে নাড়াইছড়ির দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। উপজেলা সদর থেকে নাড়াইছড়িতে যাওয়ার কোনো সড়কপথ নেই। 

স্থানীয় একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, করোনার প্রভাবে এখানকার ২৫টি গ্রামের মানুষেরা তীব্র খাদ্যসংকটে পড়ে। অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছিল তাদের। বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেখানে ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আর ত্রাণ বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেন নাড়াইছড়িবাসীকে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সেই মতো ৫০০ পরিবারের জন্য ত্রাণের প্যাকেট রাখা হয় দীঘিনালা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ধনপাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গত শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ৫০০ পরিবারের জন্য উপহার বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করে উপজেলা প্রশাসন। প্রতিটি প্যাকেটে ছিল ৩০ কেজি চাল, ১ লিটার সয়াবিন, ২ কেজি আলু, আধা কেজি মসুর ডাল।

নাড়াইছড়ি থেকে শনিবার ভোর চারটার দিকে ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবী ধনপাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁরা স্কুল প্রাঙ্গণে পৌঁছান দুপুর ১২টায়। ৫০ পরিবারের ত্রাণ বুঝে নিয়ে এক ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে স্বেচ্ছাসেবকেরা ফিরতি যাত্রা করেন নাড়াইছড়ির উদ্দেশে। নদী, ছড়া, মেঠোপথ পার হয়ে প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর পরদিন রোববার রাত নয়টার দিকে তাঁরা পৌঁছান ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী দুর্গম নাড়াইছড়িতে।

স্বেচ্ছাসেবকদের একজন অনন্ত চাকমা (২৬)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাড়াইছড়ি এলাকার বাসিন্দাদের দুঃখ, কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউএনও বরাবর আবেদন জানিয়েছিলাম। ইউএনও আমাদের কষ্টের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা নাড়াইছড়ি এলাকার ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবী শনিবার দুপুরে ধনপাতায় এসে ত্রাণ বুঝে নিই। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পরদিন রোববার রাত ৯টায় নাড়াইছড়ি পৌঁছাই।’

অনন্ত চাকমা জানান, কোথাও নদী ও ছড়ায় বাঁশের ভেলায় ত্রাণের প্যাকেট ভাসিয়ে, আবার কোথাও দীর্ঘ পথ হেঁটে তাঁরা নাড়াইছড়ি পৌঁছেছেন।

৫ নম্বর বাবুছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সন্তোষ জীবন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা সদরের সঙ্গে নাড়াইছড়ির সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষাকালে নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। শুষ্ক´মৌসুমে জঙ্গল পরিবেষ্টিত মেঠোপথ ধরে হেঁটে চলা একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। করোনা সংকটে নাড়াইছড়ি এলাকার চন্দ্র মোহন কার্বারী পাড়া, বাঙালীচান কার্বারী পাড়া, ধীরেন্দ্র হেডম্যান পাড়া, শান্তি কুমার কার্বারী পাড়া, কালেন্দ্র কার্বারী পাড়া, শালুয়া কার্বারী পাড়া, বুদ্ধধন কার্বারী পাড়া, যোগেশচন্দ্র কার্বারী পাড়া, পূর্ণজয় কার্বারী ও সাধন কুমার কার্বারীপাড়াসহ ২৫টি গ্রামে বসবাসরত পাঁচ শতাধিক পরিবার অর্ধাহারে–অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল। গ্রামগুলোর দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ১২০ জন নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক পৌঁছে দিয়েছেন।

দীঘিনালার ইউএনও মোহাম্মদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে এলাকায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁরা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মনে করি।’