আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে ভাবছেই না মেঘনাপাড়ের মানুষ

ভোলার সাগর মোহনার ইউনিয়ন ঢালচর থেকে লোকজনকে মূল ভূখণ্ডে নিরাপদে সরিয়ে আনা হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকেলে চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো
ভোলার সাগর মোহনার ইউনিয়ন ঢালচর থেকে লোকজনকে মূল ভূখণ্ডে নিরাপদে সরিয়ে আনা হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকেলে চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

‘যেসুম ঝড় আইবো, হেসুম দেহুম। এমনেই করোনায় ব্যাডাগো (স্বামী) কাম-কাজ নাই, আবার আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়া কোন মছিবতে পরুম, জানি না।’

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রস্তুতি নিয়ে ভোলার সদর উপজেলার দক্ষিণ ধনিয়ার মেঘনাতীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে বসবাসকারী গৃহিণী নুরুন্নাহার (৪৫) এভাবেই নিজের কথা বলছিলেন। তাঁর মতোই ভোলার মানুষেরা এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে ভাবছেন না। ঘূর্ণিঝড় আম্পান আসার খবরে সবাই নিজের মালসামানা হেফাজতে রাখতে ব্যস্ত। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্র যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। এ বিষয়ে কিছু ভাবতেও চাচ্ছেন না। ভোলার বিভিন্ন এলাকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোলার আকাশ ছিল ঝকঝকে। গরম ছিল প্রচণ্ড। দুপুর ১২টার দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়। তারপর থেকে আকাশ মেঘলা। সন্ধ্যার দিকে আবার বৃষ্টি নামে। স্বাভাবিক দিনের মতো সকাল থেকে মানুষ খেতে-খামারে কাজ করতে নেমেছে। লোকজনের মধ্যে খেতের ফসল তোলার তাড়াহুড়ো দেখা যায়। ভোলার রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল, ফেরিঘাট, নাদর মিয়ারহাট, কাচিয়া, তুলাতুলি মেঘনা নদীতে বিকেল পর্যন্ত জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যায়। ট্রলার ও ফেরিতে মানুষ আসছে জন্মভূমিতে ঈদ করতে। নদীর গতিপ্রকৃতি ছিল দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিক। ঢেউ ছিল কম। তবে দুপুরের পরে ঢেউ বাড়তে থাকে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ফসলি খেতে কেউ ধান কাটায় ব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত বাদাম, মরিচ তোলার কাজে। লোকজন সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার চেয়ে খেতের ফসল, খামারের হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু সামাল দিতে ব্যস্ত। পূর্ব ইলিশা যুব ফাউন্ডেশন ও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝড়ের ভয়াবহতা বোঝাচ্ছেন।

পূর্ব ইলিশা যুব ফাউন্ডেশনের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, সকালের দিকে আকাশের অবস্থা পরিষ্কার থাকলেও দুপুরে বৃষ্টির পরে ঝড়ের আভাস বোঝা যাচ্ছে। তারপরেই কর্মীদের লোকজনকে সতর্ক করার জন্য নামিয়েছেন।

সদর উপজেলার রাজাপুরের ৭৫ বছরের রুহুল আমিন আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঝড়ের তো কোনো আলামত দেহি না, আল্লাই ভরসা!’ তাঁর বাড়ি বাঁধের বাইরে। যদি জলোচ্ছ্বাস হয়, তবে প্রথম ঢেউয়েই তাঁর ঘরটি ভেসে যাবে, এ আশঙ্কাতে আছেন রুহুল আমিন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে চিন্তা করেননি। কতগুলো গরু-ছাগল আছে। চিন্তা তাঁর সেগুলো নিয়ে।

রাজাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর থেকে শুরু করে দক্ষিণে পূর্ব-ইলিশা হাজিবাড়ি পর্যন্ত পাকা ফোল্ডার (ব্লক) ফেলা হচ্ছে নদীর তীরে। এখানে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও নির্মাণ হয়েছে নতুন করে। এ বাঁধের উচ্চতা ৬ মিটার। কিন্তু তারপর দক্ষিণে নিচ কাচিয়া পর্যন্ত ব্লক নেই। এখানের বাঁধও অনেকটা চিকন আর সংস্কারযোগ্য। নিচু। ব্লকবাঁধ নেই ধনিয়া ইউনিয়নের মুন্সিবাড়ি থেকে কোড়ারহাট পর্যন্ত। এসব বাঁধের দুপাশ দিয়ে ভাঙা, গর্ত, দুর্বল। পানির ঢেউ প্রথম ধাক্কায় শেষ করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।

ধনিয়া গঙাকৃর্তি এলাকার বাসিন্দা প্রভাষক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘দুপাশ দিয়ে ব্লক থাকলেও মাঝে (এক হাজার ৩০০ মিটার) কোনো ব্লকবাঁধ নেই। নিয়মিত ভাঙনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও হুমকির মুখে। এ অবস্থায় সুপার সাইক্লোন আম্পান আসছে। ঝড়ের কারণে যতটা না আতঙ্কিত, লোকজন দুর্বল বাঁধের কারণে তার থেকে বেশি আতঙ্কিত!’

পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের সোনাডুগি গ্রামের মো. ইউসুফ (৪৮) তাঁর মুরগি ও গরুর খামারের চারপাশে মোটা জিআই তার দিয়ে টানা দিচ্ছেন। ইউসুফ বলেন, ‘ভোলার মানুষের পরান শক্ত। ৭ নম্বর সতর্কসংকেতেও নদীতে মাছ ধরতে নামছে। ট্রলারে ওপারেত্তোন বাড়ি আইয়ে। এগুন সাইক্লোন শেল্টারে যাইব বাড়িত পানি উইটলে। কিন্তু আবহাওয়াটা দম ধরি আছে। গুমোট। মনে হয়, যেকোনো সুম হালুম করি সব ম্যাচাকার করে দিব।’

ইলিশার মৌলভীরহাট ফাজিল মাদ্রাসা ও গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার দুটি খোলা হয়েছে। তবে সেখানে কেউ আশ্রয় নিতে আসেননি। আশ্রয়কেন্দ্রে ইউনিসেফ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু ধনিয়ার ৩৬ নম্বর ধনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর গঙ্গাকৃর্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলেনি।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ভোলার চারপাশে যে বাঁধ আছে, তা স্বাভাবিক জোয়ার, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহনীয়। সুপার সাইক্লোনসহনীয় নয়। পর্যায়ক্রমে সুপার সাইক্লোন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহনীয় করা হবে। যদি আম্পান সাতক্ষীরা-ভারতের ওপর দিয়ে যায়। তবে ভোলার তেমন ক্ষতি হবে না। এখন আল্লাহই ভরসা!’

ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, ৮৫টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৭৭টি বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত আছে। আছে পর্যাপ্ত খাদ্য। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে নিরাপদে আসতে বলা হচ্ছে।