নবজাতক হাসপাতালে ফেলে চলে গেলেন সেই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী

মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী সন্তান প্রসব করেছেন। শিশুটিকে ঘিরে আনন্দিত নার্স ও চিকিৎসকেরা। গত সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। ছবি: প্রথম আলো
মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী সন্তান প্রসব করেছেন। শিশুটিকে ঘিরে আনন্দিত নার্স ও চিকিৎসকেরা। গত সোমবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ১৬ মে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন। কেউ তাঁর নাম–পরিচয় জানে না, জানে না ওই শিশুর বাবার পরিচয়। ওই নারী গত চার দিন হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের কাছে থাকলেও সন্তানের কোনো যত্ন নেননি। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার ভোরে কাউকে কিছু না বলে নবজাতক ফেলে হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন।

প্রসূতি ওয়ার্ডের শয্যায় ওই নবজাতক যখন কান্না করছিল, তখন সবার নজরে আসে, তার মা আশপাশে নেই। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ আর ওই নারীকে খুঁজে পায়নি। ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স সাদিয়া আক্তারের তত্ত্বাবধানে শিশুটিকে রাখা হয়েছে।

সদর হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স সাদিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল সাতটার দিকে ফোনে জানতে পারি, নবজাতককে ফেলে ওই পাগলিটা পালিয়েছেন। মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন শিশুটার কী হবে? কে খাওয়াবে বুকের দুধ। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসি। প্রসূতি বিভাগে ভর্তি থাকা অনেক নারীকে অনুরোধ করেছিলাম একটু বুকের দুধ দিতে। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। বেলা বাড়ছে আর শিশুটি ক্ষুধায় কান্না করছে। তা সহ্য করতে পারছিলাম না। তখন বিকল্পভাবে শিশুখাদ্য দেওয়ার চেষ্টা করি।’

সাদিয়া বলেন, ‘পাগলির শিশুটিকে পেয়ে আমরা অন্য রকম সুখ অনুভব করছিলাম। হয়তো করোনার কারণে দীর্ঘদিন পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে গিয়ে মনের অজান্তেই মাতৃত্ববোধটা আরও বেশি জাগ্রত হয়েছে। গত চার দিনে ওই শিশুকে ঘিরে আমরা ও চিকিৎসকেরা অনেক আনন্দে ছিলাম। পাগল হলেও মা তো? কাছে ছিল, খাওয়াতে পেরেছে। কিন্তু এখন এই দুধের শিশুর কী হবে?’

নড়িয়া থানা সূত্র জানায়, শনিবার বিকেলে পুলিশের কাছে খবর আসে, নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী গাড়ির নিচে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। স্থানীয় লোকজন ওই নারীকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছিলেন না। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নড়িয়া থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ গিয়ে দেখেন, ওই নারী প্রসববেদনায় ছটফট করছেন। দ্রুত তিনি তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদনে নিয়ে যান। সেখানে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রসব করাতে না পেরে রাত ১০টায় তাঁকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে পাঠান। শনিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।

এ নিয়ে গত সোমবার (১৮ মে) প্রথম আলো প্রিন্ট সংস্করণে ‘পাগলিটা মা হলো, বাবা হলো না কেউ’ এবং পরে ওই দিন অনলাইনে ‘করোনাকালে হাসপাতালে একচিলতে সুখ হয়ে এসেছে এক “পাগলির” নবজাতক’ শিরোনামে দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান বলেন, ‘ওই নারী ও নবজাতক শারীরিকভাবে সুস্থ ছিল। তাঁর শিশুসন্তান নিয়ে হাসপাতালের নারী কর্মী ও চিকিৎসকেরা খুব আনন্দে ছিলেন। তাঁকে সরকারি পুনর্বাসন ও চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে পাগলিটা সন্তান ফেলে পালিয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে আমাদের কর্মীরা তাঁকে খুঁজেছে। পুলিশ সকাল থেকেই তাঁকে খুঁজেছে। এখন বিষয়টি লিখিতভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও সমাজসেবা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যতক্ষণ তারা কোনো ব্যবস্থা না করতে পারবে, ততক্ষণ শিশুটি আমাদের কাছেই থাকবে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গাজীপুরে একটি আশ্রয় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে ভবঘুরে, নিরাশ্রয় ও মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের আশ্রয় দেওয়া হয়। ওই আশ্রয়কেন্দ্রে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী ও তাঁর শিশুসন্তানকে পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছিল। অনেক প্রক্রিয়ার বিষয় তো, তাই একটু সময় লাগছিল। এমন পরিস্থিতিতে শিশুটার মা তাকে ফেলে চলে যাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়ে গেলাম।’

শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘ওই নারী ফুটপাতে প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। সেখানে সন্তান প্রসব করায় আমরা সবাই আনন্দিত হয়েছিলাম। আমরা ভাবতেও পারিনি এভাবে সন্তান হাসপাতালে ফেলে সে পালাবে। তাকে খোঁজা হচ্ছে। বিভিন্ন থানায় বার্তা পাঠানো হয়েছে তাকে খোঁজার জন্য।’