'ভিডিও কলে আম্মু বললেন, আমি যেন দরজা খুলে একটু বাইরে দাঁড়াই'

মারজিয়া ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মারজিয়া ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

২৬ বছর বয়সী মারজিয়া ইসলাম পেশায় ব্যাংকার। কাজের অবসরে পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরেফিরে, আড্ডা দিয়ে বেড়ানোর মানুষ তিনি। তবে নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর থেকে এই মারজিয়াকেই একটি ঘরে একা কাটাতে হচ্ছে প্রায় ৪০ দিন ধরে। টেলিফোনে বললেন, ‘একটা ঘরে এত দিন ধরে একা কাটানো খুব কষ্টের। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণাটা অনেক বেশি। নিজের পাশাপাশি ঘরে থাকা বাবা, মা এবং একমাত্র বোনটার জন্যও সারাক্ষণ চিন্তা হয়। শুধু বলি, আমার  থেকে পরিবারের আর কেউ যেন কোনোভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হন।’

১৪ এপ্রিল। মারজিয়া ইসলামের (খেয়া) গলাব্যথা শুরু হয়। তখন থেকেই তিনি কোয়ারেন্টিনে চলে যান। এরপর কাশি, জ্বরসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। ১৯ এপ্রিল প্রথম করোনা টেস্ট করা হয়। ২১ এপ্রিলের ফলাফলে করোনা পজিটিভ আসে। করোনার উপসর্গের তীব্রতা বাড়তে থাকে। প্রচণ্ড ক্লান্তিবোধ শুরু থেকেই ছিল, যা এখনো বিদ্যমান। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ফলোআপের জন্য প্রথম স্যাম্পল নিয়ে যায় ২৯ এপ্রিল। এরপর আইইডিসিআর জানায়, বাড়ি গিয়ে নমুনা নেওয়া হবে না। ফলোআপ প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

মারজিয়া ইসলাম বললেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে শুরু থেকেই নেতিবাচক ধারণা ছিল। তাই চেষ্টা করেছি যাতে কোনোভাবেই হাসপাতালে যেতে না হয়। ফলোআপের জন্য বাইরে হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে স্যাম্পল দেওয়ার বিষয়টিও মনের মধ্যে ভয় হিসেবে কাজ করে। বাসার অন্য সদস্যরা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে। আর লাইনে দাঁড়িয়ে অন্যদের কাছ থেকে পরিবারের সদস্যরা যে ভাইরাস নিয়ে বাসায় ফিরবে না, তারও গ্যারান্টি নেই। পরে ১৩ মে অনেক চেষ্টা করে বাসা থেকে স্যাম্পল নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ফলাফল নেগেটিভ আসে। এরপর ১৬ মে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বাসা থেকে আমার স্যাম্পল নিয়ে যায়। তবে তার ফলাফল আবার করোনা পজিটিভ এসেছে। তার পর থেকে আবার ১৪ দিনের জন্য ঘরবন্দী হলাম। আবার শুরু হয়েছে অপেক্ষার পালা।’

২১ এপ্রিল থেকে মুঠোফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ, ই-মেইলসহ ডিজিটাল মাধ্যমে রোগের উপসর্গ শুনে, স্কাইপেতে কথা বলে এবং আগের রোগসংক্রান্ত রিপোর্ট থাকলে তা দেখে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শতাধিক চিকিৎসক (বেশির ভাগই বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত) চিকিৎসা অথবা পরামর্শ দিচ্ছেন। রোগীকে যথাযথ জায়গায় রেফার করা বা টেলিফোন নম্বর দিয়ে সহায়তাও করছেন চিকিৎসকেরা। সম্প্রতি বেসরকারিভাবে বাসা থেকে রোগীর স্যাম্পল কালেকশন করার কাজটি করছে এ সংগঠন।

মারজিয়া ইসলাম বললেন, ‘ঘরে থেকে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা কঠিন। যারা ঘরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনাও নেই। অবস্থা খারাপ হলে রোগীরা কোন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে (রেফারেল চিকিৎসক), তাও বলে দেয়নি সরকার। ফলে  রোগীদের নিজেদেরই চিকিৎসক খুঁজে বের করতে হচ্ছে।’

মারজিয়া ইসলাম গত ২২ মার্চ রাজধানীর পুরানা পল্টনে তাঁর কর্মস্থলে গিয়েছিলেন। এরপর মূলত বাসাতেই ছিলেন। দু-এক দিন প্রয়োজনে ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। বাসায় পার্সেলের মাধ্যমে কিছু পণ্য কিনেছিলেন। তাই তিনি কোন জায়গা থেকে বা কীভাবে ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, তা জানেন না বলে জানান।

  মারজিয়া ইসলাম জানালেন, ঘরে বসে তিনি বই পড়ছেন। সিনেমা দেখছেন। ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন। তবে এভাবে একদম মানুষের সংস্পর্শে না এসে সময় কাটানো কঠিন বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘রাতে ঘুম হচ্ছে না। বলতে গেলে ভোর পর্যন্ত জেগে থাকি। দরজার বাইরে ডিসপোজিবল পাত্রে পরিবারের সদস্যরা খাবার রেখে যান। দিন, তারিখ, মাসের কোনো হিসাব মনে নেই। বাথরুম পরিষ্কারসহ নিজের কাজগুলো এমনকি শরীর যত খারাপই লাগুক না কেন, ওষুধটাও একাই খেতে হচ্ছে। পরিবারের কেউ আমার কাছে আসতে পারছে না। সে যে কি কষ্ট! আম্মুর সেদিন ভয়াবহ রকমের মন খারাপ হয়েছিল। ভিডিও কলে আম্মু বললেন, আমি যেন দরজা খুলে একটু বাইরে দাঁড়াই। আমি দাঁড়ালাম, আম্মু দূর থেকে দেখে আর কান্না সামলাতে পারছেন না...। বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে নিয়েছি। এবার আশা ছিল রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। তা তো হলো না।’ বললেন মারজিয়া ইসলাম।

যখন পুরোপুরি সুস্থ হবেন সেদিন কী করবেন? জানতে চাইলে মারজিয়া বললেন, ‘চূড়ান্ত ফলাফল হাতে পেয়ে প্রথমেই এ ঘরটা পরিষ্কার করব, যাতে কোথাও কোনো জীবাণু না থাকে। এ কাজ অন্য কাউকে করতে দেব না, আমি নিজে করেই ঘর থেকে বের হব।’

মারজিয়া ইসলামের পরিবারে করোনাভাইরাস নিয়ে ভীতি শুরু হয়েছিল সেই মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে। প্রথমে মারজিয়া ইসলামের বোন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রভাষক মুশফেকা ইসলামের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি আছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তবে করোনা পরীক্ষা করাতে বেশ জটিলতার সম্মুখীন হন। ৩১ মার্চ করোনার ‘রেজাল্ট নেগেটিভ’ খবরটিও ফেসবুকে জানান মুশফেকা।

মুশফেকা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর পরিবার যে কী শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটায়, সেটা দূর থেকে বুঝবে না কেউই। আমিও আগে বুঝিনি। বোনের শারীরিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল, তবে সেরে উঠতে সময় লাগছে বেশি। মা রাতে ঘুমান না, ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় যদি বোনের হঠাৎ শরীর খারাপ করে, সে চিন্তায়।’

মুশফেকা বললেন, করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থাটি অত্যন্ত ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় অনেক পজিটিভ রোগীই আর ফলোআপের ঝক্কিতে পড়তে চান না। অনেকেই ১৪ দিন পর সেরে উঠেছেন বলে ধরে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করছেন। আমেরিকাতেও রোগীদের সেরে উঠতে গড়পড়তা ৬ সপ্তাহ লাগছে। তাই ঝুঁকি এড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল মেনে পরপর দুবার নমুনা নিয়ে রোগীর ফলোআপ করাটাই সবার জন্য নিরাপদ হবে।