সিগারেটের মূল্যস্তর এবারও কমছে না

মানুষ ধূমপান কমিয়ে দিতে পারে—এমন আশঙ্কায় সিগারেটের মূল্যস্তর এবারও কমানো হচ্ছে না। আবার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আরোপ করা হচ্ছে না এগুলোর ওপর বাড়তি করও। ফলে দেশের দামি সিগারেটগুলোর দাম খুচরা বাজারে প্রতি বছর ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা করে যে বাড়ে, এবারও তাই বাড়বে।

বাজেট প্রণয়নে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, 'সিগারেটের মূল্য স্তর চারটি থেকে কমিয়ে দুটিতে নিয়ে আসার বিষয়ে অনেক ভাবা হয়েছে। কিন্তু এখনই তা সম্ভব হচ্ছে না। পরে এর নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
দেশে তামাক খাতের কর-কাঠামো জটিল, ধূমপানে নিরুৎসাহিত করে না। যে কর-কাঠামো বহাল আছে, তা মাত্র বিশ্বের ৫ থেকে ৬টি দেশে আছে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য করকাঠামো বদলানোর পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। চার বছর পার হলেও এ ঘোষণা বাস্তবায়নের কিছুই হয়নি।

তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রবর্তন, সিগারেটে দুটি মূল্যস্তর এবং সিগারেটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বহু বছর ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। এছাড়াও তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপের দাবি জানা্চ্ছে সংগঠনগুলো। কিন্তু সরকার বরাবরের মতো এবারও তা আমলে নিচ্ছে না।

সিগারেটের মূল্যস্তর বর্তমানে ৪টি। কমিয়ে নিম্ন এবং প্রিমিয়াম-এ দুটিতে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে তামাকবিরোধী জোট অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা), তামাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞানসহ (প্রজ্ঞা) ৫টি সংগঠন। এসব তামাকপণ্যে ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারসার্জ, খুচরা মূল্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখারও পক্ষে তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৮ সালের তথ্যমতে, বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কমদামে সিগারেট পাওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য আরও সস্তা।


এ ছাড়া ২০১৯ সালে প্রকাশিত 'ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ' শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।
সংগঠনগুলো বলছে, দাবিগুলো পূরণ হলে সরকারই লাভবান হবে, অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ৬ লাখ ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং প্রায় ২০ লাখ ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। একইসঙ্গে করোনার মতো যেকোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে।

গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সারভের (জিএটিএস) ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে পাশাপাশি প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

আরও বলা হয়, তামাকের সহজলভ্যতাই এর প্রধান কারণ। কম দামে তামাকপণ্য কেনার সুযোগ এবং ত্রুটিপূর্ণ করকাঠামো বিশেষ করে সিগারেটে ৪টি মূল্যস্তর থাকায় বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমছে না। তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরৎসাহিত হয় এবং তামাক আসক্তরাও বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।
ডব্লিউএইচও তামাককে করোনা সংক্রমণ সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে। বলেছে, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০০ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক লিখিত আবেদনে তামাকপণ্যের উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের নির্দেশ দিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক হিসেবে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করছেন অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রতি বছর দাম একটু করে বাড়ায়। কিন্তু মূল্যস্তরটা এমন কারসাজিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে যে প্রতি বছর দাম একটু দাম বাড়লেও মানুষের পকেটে আর টান পড়ে না। ১০ টাকার সিগারেট এক লাফে ১৫ টাকা করলে ভোগ একটু কমত, আবার সরকারের রাজস্বও বাড়ত।
খলীকুজ্জমান আহমদ আরও বলেন, তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি এ খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব খাত থেকেও বেশি। সরকার খালি সামনেরটাই দেখে,পেছনেরটা দেখে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের বিদ্যমান চারটি মূল্যস্তর বিলুপ্ত করে দুটি নির্ধারণ করা দরকার। কারণ, একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে সিগারেট ক্রয়ের সুযোগ থাকায় ভোক্তা স্তর পরিবর্তন করার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, গবেষণায় ওঠে এসেছে, তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রস্তাব বিবেচনা করা হলে সরকার বাড়তি আয় করতে পারবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। বাজেট যেহেতু এখনো চূড়ান্ত হয়ে যায়নি, এখনও তা বিবেচনা করা যায়।