করোনা-আম্পানে ম্লান উপকূলের শিশুদের ঈদ আনন্দ

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। পরিবারের সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে শিশুরাও। ২০ মে বরগুনা সদরের পোটকাখালীর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো
ঘূর্ণিঝড় আম্পান ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। পরিবারের সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে শিশুরাও। ২০ মে বরগুনা সদরের পোটকাখালীর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো

করোনার সংক্রমণ এড়াতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে শিশুরা প্রায় গৃহবন্দী। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় সংসারে শুরু হয়েছে টানাটানি। সেসব পরিবারে খাবারের জন্য কষ্ট করছে শিশুরা। ঘরে থাকতে থাকত একঘেয়েমিতে ভুগছে মধ্য-উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা। এরই মধ্যে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ওলটপালট হয়ে গেছে উপকূলের শিশুদের জীবনযাপন। বিষাদ আর অনিশ্চয়তায় ম্লান হয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের শিশুদের এবারের ঈদ আনন্দ।

শিশু সংগঠকেরা বলছেন, আম্পানের তাণ্ডব থেকে সুরক্ষা পেতে পরিবারের সঙ্গে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া, ভয়-শঙ্কা নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করা, আবার বাড়ি ফিরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বসতঘরের দুর্দশা—এসব পরিস্থিতি উপকূলের শিশুদের মানসিক অবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে লাখো শিশু মানসিকভাবে বিপদাপন্ন। এমন অবস্থায় ঈদ এসব পরিবার এবং শিশুর জীবনে কোনো আনন্দের বয়ে আনতে পারেনি। শিশুদের জীবনে এমন নিরানন্দের ঈদ যেমন আসেনি, তেমনি বয়স্করাও এমন জৌলুশহীন ঈদ আর উদযাপন করেননি। 

বরিশাল নগরের কয়েকজন অভিভাবক আক্ষেপ করে বলছিলেন, ঈদের নতুন জামার গন্ধ, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে টুপি মাথায় দিয়ে বাবার হাত ধরে ঈদগাহে নামাজে যাওয়া, এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে নাশতা খাওয়া, পার্কে-উদ্যানে ঘুরতে যাওয়া—সবকিছু কেড়ে নিয়েছে নির্মম দুর্যোগ। 

নগরের বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়ের বাসিন্দা গৃহিণী ফাতেমা রহমান (৩২) আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আর কত? এর শেষ কোথায়? বাচ্চাদের ঘরে আটকে রাখতে রাখতে এখন দম আটকে আসছে। তিন মেয়ে প্রায় তিন মাস বাইরের আলো দেখছে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। খাবার-দাবারেও মনোযোগ কম। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ-বিষণ্ন থাকে। বাচ্চাদের এমন অসহায় অবস্থায় দিন-রাত কষ্ট পাচ্ছি। নিজেকে অসহায় লাগছে।’

ফাতেমার ছোট মেয়ে মৃত্তিকার বয়স সাড়ে ৬ বছর। মাকে বলছিল, ‘মা ঈদে এবার নতুন জামা কিনে দেবে না? প্রতিবছরই তো কিনে দাও। এবার ঘুরতে নিয়ে যাবে কোথায়?’ ছোট্ট মেয়ের কথা শুনে ফাতেমার চোখ ছলছল করে ওঠে। 

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, বিভাগের ৬ জেলায় শূন্য থেকে ১০ বছরের নিচের ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে ১৫ মাস বয়সী শিশু ২ লাখ ১৫ হাজার। 

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এমনিতেই উপকূলের শিশুরা চাহিদামতো পুষ্টি পায় না। তার ওপর করোনার কারণে অধিকাংশ পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরা। এরই মধ্যে আম্পানের হানায় এসব পরিবার আরও দুর্দশায় পড়েছে। 

বরিশাল নগরের নবগ্রাম রোডের বাসিন্দা হেনা বেগমের (৩২) স্বামী রিকশাচালক। পাঁচ বছরের মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে তিনজনের সংসার। করোনার দুর্যোগে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে খাবারেও সংকট চলছে। স্বামী রিকশা নিয়ে বের হলেও তেমন আয়-রোজগার নেই। তাই গত তিন মাস ধরে বাচ্চাকে বাড়তি কোনো খাবার দিতে পারছেন না। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলার বেশ কিছু এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কবলে পড়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারের শিশুরা পুষ্টিকর খাবার তো দূরে থাক, স্বাভাবিক খাবারও পাচ্ছে না।

বরগুনার তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙা গ্রামের দিনমজুর আলম মিয়া (৩৫) বলেন, ‘মাইয়াডার বয়স ৮ বছর। পেরতেক ঈদে অরে জামা কিন্না দি। এবার দিমু কেমনে। করোনায় আয়-রোজগার বন্ধ। হ্যারপর বইন্নায় ঘরদুয়ারের ক্ষতি। খাওনই তো জোডে না, ঈদ করমু কেমনে?’

করোনার দুর্যোগের মধ্যে ২০ মে এই অঞ্চলে আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। প্রকৃতির এমন দুর্যোগ দক্ষিণ উপকূলে নতুন নয়। দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের কোটি মানুষ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘর ভাঙে, এলোমেলো করে দেয় সাজানো-গোছানো জীবন। কিন্তু এবার করোনার মতো অদৃশ্য দানবের ছোবলের ওপর আম্পানের ধ্বংসলীলার মতো দুর্যোগ কখনো মোকাবিলা করেনি তারা। এমন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এ অঞ্চলের মানুষ। তাদের জীবনে এখন গভীর অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক। এতে সবচেয়ে বেশি অসহায় শিশুরা।

ইউনিসেফের বিভাগীয় প্রধান এ এইচ তৌফিক আহম্মেদ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারে খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়ায় অবশ্যই শিশুদের পুষ্টি শৃঙ্খলে বড় প্রভাব পড়ছে। এতে শিশুদের বিকাশ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। এতে শিশুরা মানসিকভাবে আতঙ্কিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মানসিক দুর্দশা লাঘবে অভিভাবকদের (কেয়ার গিভারে) উচিত শিশুদের যেকোনো উপায়ে সার্বক্ষণিক সক্রিয় (এনগেইজড) রাখা। শরীরচর্চা, সৃজনশীল কাজ এবং গল্প করাসহ শিশুদের সব ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া। এসব বিষয় উত্তরণে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে আমরা মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা চালাচ্ছি।’