এ দেশে বুকে আঠারো এসেছে নেমে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

বর্তমান বিশ্ব চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস নামের ক্ষুদ্র অণুজীবটির (যদিও ভাইরাসকে পুরোপুরি অণুজীব বলা যায় না) দৌরাত্ম্য সমগ্র বিশ্বের আনাচকানাচে পৌঁছে যাচ্ছে।

আমাদের দেশেও করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। দেশের গণমানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা বেশ কিছুদিন ধরে কর্মবঞ্চিত। আসলে লকডাউনের বাইরে সরকারের আর কোনো উপায় ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার মানবিক সাহায্য নিয়ে অসহায় কর্মবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সব পেশাজীবী মানুষের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সেক্টরভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্ব যখন চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের সরকার দারুণ কাজ করে যাচ্ছে।

যদিও মাঝেমধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শোনা যায়। চাল চুরির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু জনপ্রতিনিধি ধরা পড়েছেন। আমি চিন্তা করে পাই না যে চালচোরেরা কীভাবে তার সন্তানদের সামনে মুখ দেখায়। গরিবের চাল চুরির আগে একবারও কি তাদের সন্তানদের সামাজিক অবস্থানের কথা মাথায় আসে না। তবে এই ঘৃণিত মানুষগুলোর সংখ্যা খুব বেশি নয়। চাল চোর দমনে সরকার প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।

জনপ্রতিনিধিরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকার প্রেরিত সাহায্য নিয়ে অসহায় মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্ঘুম অবস্থায়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকার ঘোষিত সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। পুলিশ প্রশাসনও বেশ নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্গে মাঠে রয়েছেন। চিকিৎসকেরা তো জাতীয় বীর হিসেবে গণমানুষের কাছে সম্মানের জায়গা দখল করে নিয়েছেন।

এত কিছুর বাইরে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, একটি বিশেষ বয়সের মানুষেরা কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কার্যক্রমে নিজেদের চমৎকারভাবে নিয়োজিত করেছেন। এই অংশটি হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, যারা কেউ স্কুলে, কেউ কলেজে, কেউ ইউনিভার্সিটিতে কেউ হয়তোবা শিক্ষাগণ্ডির বাইরে থেকেও যুক্ত আছেন।

আমাদের দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে তরুণ প্রজন্ম নিঃস্বার্থভাবে, বরং শারীরিক পরিশ্রম, কেউ মেধাশ্রম ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে সমকালীন সংকট মোকাবিলায় মানবিক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। যদিও শিশু–তরুণদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদের ক্লাসরুম, খেলার মাঠ, পাঠচক্র, সামাজিক সংঘ—সবকিছু বন্ধ। তারা এখন এক অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় আটকে পড়েছে। তারা আবার মাঠে খেলতে চায়, প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে চায়, চায় সামাজিক সংঘে ফিরে যেতে। এই অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তারা মুক্ত বাতাসের খোঁজে হাঁসফাঁস করছে। আর এই তরুণদের মধ্য হতে একদল নিরলসকর্মী মানবিক সেবায় ব্রতী হয়েছেন।

‘বিদ্যানন্দ’ নিয়ে আমরা সবাই জানি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ ভালো কাজ করে যাচ্ছে। আর এ সংগঠনের বড় অংশই তরুণ বয়সের, কেউবা যুবক। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে, কোনো কোনো শিশুও তার অনেক শখ করে জমানো অর্থটুকুও ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দিচ্ছে। এ খবরগুলো আমার বেশ ভালো লাগে। চিন্তা করি যে এমন একটি কঠিন সংকটের ভয়াবহতা আমাদের নবপ্রজন্মের অন্তরে মানবিকতার বীজ বপন করছে, সুপ্ত মানবিকতাকে জাগ্রত করে তুলেছে।

দেশের কিশোর-কিশোরীদের অন্যতম নেটওয়ার্ক ‘স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন’। এই নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিরা সাহাযের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরই মধ্যে রাজশাহীতে ইরা, দিনাজপুরে সাইফুল, নীলফামারীতে অঙ্কুর, ঠাকুরগাঁওয়ে লুমিন, সিলেটে সোনালি, গাজীপুরে টুম্পা, রাঙামাটিতে ইসরাত সৌহার্দ্য হিসেবে খাবার প্যাকেজ অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এরা স্কুল-কলেজপড়ুয়া। এদের কার্যক্রম আমাকে অভিভূত করেছে।

টিফিনের টাকা ত্রাণ তহবিলে দান করেছে জয়পুরহাটের ক্লাস সেভেনপড়ুয়া ছাত্র মওদুদ। নিজের শখের মাটির ব্যাংকটিই দিয়ে দিয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের শিশু শাহরাজ, মুসলমানি অনুষ্ঠানে উপহারের ৫৫ হাজার টাকার পুরোটাই দান করেছে শিশু শোয়াইব। রাজশাহীতে শিশু আরিফ ত্রাণ তহবিলে দিয়েছে ৬০ হাজার টাকা। পিরোজপুর কালেক্টরেট স্কুলের শিক্ষার্থীরাও তাদের ঈদ পোশাকের সমমূল্য টাকা দান করেছে বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবায়। এমন অনেক মানবিকতার উদাহরণ তৈরি হয়েছে সারা বাংলাদেশে। বরিশালের হিজলা উপজেলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সাইদুল মাহিম, আবদুল্লাহ নোমান, আবরার মাকসুদসহ বেশ কয়েকজন উদ্যোগী তরুণ ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে স্থানীয় বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কর্মবঞ্চিত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে ইফতার উপহার। দেশের সব প্রান্তরে এমন মানবিক কাজ করে যাচ্ছে আমাদের তরুণসমাজ। কেউবা নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে প্রশাসনকে সাহায্য করে যাচ্ছে।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আঠারো বছর বয়স’ কাব্যগ্রন্থে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। কবিতায় উপস্থাপিত বিযয়গুলো মোটামুটি এ রকম: ‘প্রবল আবেগ ও উচ্ছ্বাসে ঝুঁকি নেওয়ার উপযোগী বিধায় এ বয়সে যে কেউ হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর। এ বয়সে তরুণেরা সব বাধা–বিপদ পেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। জীবনের এই তারুণ্যে নানা জটিলতাকে অতিক্রম করতে হয়। আর এই সময়ে সচেতনভাবে নিজেকে পরিচালনা করতে না পারলেই জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়, আর এ বয়সটি হয়ে উঠতে পারে জীবনের কালো অধ্যায়। এত কিছুর বাহিরে এ বয়সের আছে দেশের সংকট ও দুর্যোগ মোকাবিলার দুর্বার প্রাণশক্তি। তারুণ্যের দীপ্ত তেজ আর যৌবনশক্তি নিয়ে এ বয়স এগিয়ে যায় সমস্যা-সংকট উত্তরণের দিকে।’ দুর্বার গতি, সেবাব্রত, নবজীবন রচনার স্বপ্ন—এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য কবি প্রত্যাশা করেছেন দেশে তারুণ্য ও যৌবনশক্তি যেন জাতীয় জীবনের চলনশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিভাবান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতার শেষে তারুণ্যের জয়গান করে বলেছেন—
‘এ বয়স যেন ভীরু কাপুরুষ নয়/ পথ চলতে যায় না থেমে/ এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়—/ এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। আর আমার এখন মনে হয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রত্যাশা ১৯৭১ সালের মতো আবারও বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই আমি বলব, এ দেশের বুকে আঠারো এসেছে নেমে।

*লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও সভাপতি (এলডব্লিউএস), নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব, ঢাকা। [email protected]