দিন-রাতে দুবার করে ভাসছে তাদের ঘরদোর
হামিদা বেগম (৩০) স্বামী-সন্তান আর শ্বশুর–শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন পায়রা নদের পাড়ে বেড়িবাঁধের ভেতর। ছোট টিনের জরাজীর্ণ ঘরে বসতি এ দিনমজুর পরিবারের। গত বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় পাশের ভাঙা বাঁধ দিয়ে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে স্রোতের মতো শোঁ শোঁ করে পানি ঢুকে পড়ে পুরো গ্রামে। ঘরের ভেতরে বুকসমান পানিতে থইথই। জোয়ারের উচ্চতা শেষাবধি এতটা উচ্চতায় উঠে যে ঘরের টিনের চালা ছুঁইছুঁই। হামিদা ও তাঁর পরিবার অবস্থা বেগতিক দেখে সন্ধ্যার পরেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটে যান কিছু দূরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে। স্বামী বশির উদ্দীন ঘর পাহারায় থেকে যান। রাত সাড়ে আটটা বাজতেই বশির আর ঘরে টিকতে পারলেন না। পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল সব। এরপর কোনো রকমে সাঁতরে বশির আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে জীবন বাঁচান। সেই থেকে জোয়ারের উচ্চতা থামছে না। ছয় দিন ধরে দিন-রাতে দুবারের জোয়ারের পানিতে ভাসছে তাঁদের ঘরদোর। রান্না করবেন, এমন ব্যবস্থাও নেই।
হামিদার মতো বরগুনার বঙ্গোপসাগর তীরের উপজেলা তালতলীর জয়ালভাঙা, অংকুজানপাড়া, খোট্টারচর, নিদ্রারচর এলাকায় অন্তত ৩০০ পরিবার এভাবে ছয় দিন ধরে জোয়ারে ভাসছেন। এসব পরিবার দিনে শুকনা স্থান খুঁজে ভাত-আলু সেদ্ধ করে কোনো রকমে দিন চালাচ্ছেন। তবে অনেকের ঘরেই খাবার নেই।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জয়ালভাঙা হামিদা বেগম বলেন, ‘ঘরে চাউল নাই। ধার-দেনা কইরা দুগ্গা আনছি। হে ইয়্যা রান্ধনের লইগ্গা আবার অনেক দূরের রাস্তার উপরে শুকনা জাগায় যাওন লাগে। ছয় দিন ধইরা ঘরে পানি ওডে। রাইতে চহির (চকি) উফরে থাহি। কিন্তু ভয়তে ঘুমাই না।’
পশ্চিম অংকুজানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আলম মিয়া বলেন, পাশেই জয়ালভাঙা বাঁধের স্লুইসটি সিডরে ভেঙে গেছে। সেটি আর মেরামত করা হয়নি। সেখান থেকে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে গ্রামে। জয়ালভাঙা থেকে নিশানবাড়িয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার বাঁধ নাজুক অবস্থায় নদীতে জোয়ার বাড়লে এসব গ্রামের মানুষ আর রাতে ভয়ে ঘুমায় না। জোয়ারের পানি বাড়লেই ঘর-দুয়ার সব জোয়ারে ভাসে।
তালতলীর খোট্টারচর এলাকার আরেক বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব জালাল উদ্দীন বলছিলেন, ‘সিডর বড় বইন্না আছিল। কিন্তু সে সময়ও এত পানি দেহি নায়। ’৬১ সালের বইন্নায় খুব পানি অইছিল। এবারও হেইরহম পানি চাইর দিন থইথই হরে। ঘর-দুয়ার সব তলাইয়্যা গ্যাছে। বান্দা উপচাইয়্যা পানি ওডে। হ্যারপর ছয় দিন ধইর্যা দিনে-রাইতে দুফির ঘর-দুয়ারে পানিতে ভাসে।
এসব গ্রামে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে জোয়ারের সময় পানি ঢুকে ভাটার সময় বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাসিন্দাদের দুর্দশার শেষ নেই। একদিকে করোনায় তারা কাজ হারিয়েছে, আর্থিক দুর্দশায় পড়েছে। এরপর আম্পানের ছোবলে আরও ভোগাচ্ছে তাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরগুনা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার আহমেদ বলেন, পাউবোর আওতায় ১৮টি স্থানে ১৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ সংস্কারে ১৪ কোটি টাকা প্রোয়োজন। বরাদ্দ চেয়ে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে।
মঙ্গলবারও আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া ও দুই থেকে চার ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা জারি করে। এ কারণে দেশের তিনটি সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি করে।
বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারকে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি করা হয়েছে।
বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৪ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. আনিসুর রহমান আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এটা আরও বেশ কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে।