মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নারী চা-শ্রমিকের কাছে আজও দুরাশা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শমসেরনগর চা–বাগানের নারী চা–শ্রমিক মনি গোয়ালা দুই সন্তানের মা। আট বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন বাগানে। অন্য সব চা–শ্রমিকের মতোই দিনের শুরু হয় কাকভোরে। সকালে ঘরদোর পরিষ্কার, সবার জন্য খাবারের আয়োজন—রোজকার বাঁধা এসব কাজে চলে যায় অনেকটা সময়। সকাল আটটার আগেই বাগানে কাজের জন্য ছুটতে হয়। টানা আট ঘণ্টা কাজ। তবে কাজ সেরে বাসায় ফিরতে ১০ ঘণ্টা পার হয়।

এখন দেশের বাগানে একজন চা–শ্রমিকের বেতন প্রতিদিন ১০২ টাকা। দারিদ্র্য, বাসস্থানের দুরবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধার অভাব দেশের ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি চা–শ্রমিকের জীবনের নিত্যসঙ্গী। এই শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। কিন্তু নারী শ্রমিকদের কষ্টটা যেন আরও বেশি। রোদ–বৃষ্টি–ঝড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পাতা তুলতে হয়। পা ও কাঁধে ব্যথা প্রায় সব নারীরই লেগে আছে। তবে প্রতি মাসে মাসিকের দিনগুলো আসে বিপর্যয় নিয়ে। তখন দুর্ভোগ আরও বাড়ে।

মণি গোয়ালা বলছিলেন, মাসিকে শাড়ি বা কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করেন প্রায় সব শ্রমিক। সেগুলো তো দিনের মধ্যে পাল্টাতে হয়। কিন্তু সেই সুযোগ কোথায়? পানির যে ব্যবস্থা থাকতে হবে, সেটা নেই। খুব প্রয়োজন হয়ে পড়লে নারীরা আশপাশের ছড়া বা খালের পানিতে কাপড় ধুয়ে নেন। নয়তো সারা দিন ওই এক কাপড়ে থেকে আট–নয় ঘণ্টা পর লেবার লাইনে (শ্রমিকদের থাকার জায়গা) গিয়ে স্নান সারতে হয়।

বাংলাদেশে (পঞ্চগড় বাদ দিয়ে) মোট চা–বাগানের সংখ্যা ১৬০। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগর উপজেলার এই চা–বাগান একটি। দেশের মোট চা–বাগানের ৯২টি বাগানই মৌলভীবাজার জেলায়। চা–বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি চা–শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী।

একাধিক নারী শ্রমিক জানান, কখনো কখনো খুব প্রয়োজন হয়ে গেলে বাগানের কাছের ছড়া বা খালের পানিতে তাঁরা কাপড় ধুয়ে নিতে বাধ্য হন। নোংরা পানি আরও অসুস্থ করে তোলে।মণি গোয়ালা বলেন, 'শুধু আমি না, মাসিকের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাবে সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়াটা বাগানের একটা বাস্তবতা।'

মণি এখন মাসিকের সময়কার পরিচর্যা সম্পর্কে কিছু জেনেছেন। তিনি জানেন, স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহার করলে এ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। মণির কথা, 'যে শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা আয় করে, তার জন্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ব্যয় করা বিলাসিতাই তো। তাই পারি না। আমি জানি সুস্থা কীভাবে থাকতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ তাও জানে না। তাদের আমরা পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান তো দিতে পারি না।'

শমসের নগর চা–বাগানেই থাকেন মেরি রালফ (৪৫)। তিনি ওয়ার্ড গার্ল হিসেবে কাজ করেন শমসেরনগরের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। মেরি বলেন, 'কাজের জায়গায় পানির ব্যবস্থা না থাকায় নানা সমস্যায় নারীদের পড়তে দেখা যায়। আমাদের কেন্দ্রে আসা নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগ যেসব সমস্যা নিয়ে আসেন, তা সৃষ্টি হয় পানি কম পান করার জন্য বা মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা না করার জন্য।'

শমসেরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মুন্না সিনহার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো,
বেশির ভাগ নারী হাসপাতালে অসেন স্বাস্থ্যবিধি না পালন করার কারণে সৃষ্ট সমস্যা থেকে। এর মধ্যে ইউরেনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের (ইউটিআই) সমস্যায় বেশি আসেন। সাদা স্রাবেরও সমস্যা আছে। শুধু বাগানের শ্রমিকদের না, অন্য নারীদেরও এ সমস্যা আছে। তবে বাগানের শ্রমিক নারীদের এ সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি।

চা–শ্রমিক নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য বিধির করুণ হাল উঠে এসেছে গবেষণায়।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান ও উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী নিবেদিতা চৌধুরী চা–শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধির ওপর একটি গবেষণার কাজ করেন। এটি ছিল তাঁর স্নাতকোত্তর শ্রেণির গবেষণার কাজ। গবেষণা নিবন্ধটি আন্তর্জাতিক সাময়িকী এশিয়ান জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেমশন, ইকনোমিকস অ্যান্ড সোশিওলজিতে প্রকাশিত হয় গত বছর।

গবেষণায় জরিপ চলে সিলেট শহরের কাছের তারাপুর, মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা–বাগানের ৮০ নারী শ্রমিকের ওপর। সরাসরি সাক্ষাৎকার এবং বইপত্র, সাময়িকী থেকেও তথ্য নেওয়া হয় গবেষণার কাজটি করার সময়। গবেষণায় দেখা যায়, ৯২ ভাগ নারী শ্রমিকই মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করেন না। তাঁরা সাধারণ কাপড় ব্যবহার করেন। ৭৮ শতাংশ শ্রমিক টয়লেটের পর এবং খাবার রান্নার আগে ভালো করে ধোন না।
আর ৫৭ ভাগ নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই।

গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান ও উন্নয়ন বিভাগের এখনকার চেয়ারম্যান মিন্টু চৌধুরীর তত্ত্ববধানে এই গবেষণা করেন নিবেদিতা চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নারী চা–শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার ক্ষেত্রে প্রধান কারণ তাঁদের দারিদ্র্য। স্বল্প মজুরি তাঁদের এমন অবস্থার কারণ। আর এই অবস্থাকে তাঁরা অনেকেই নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

আর্থিক সামর্থ্যের কারণে প্যাড ব্যবহার না করতে পারলেও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন সুতির কাপড় ব্যবহার ভালো বিকল্প হতে পারে, এমনটাই মন্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিমের। তিনি বলেন, কিন্তু সেই কাপড় অবশ্যই ছয় ঘণ্টা পর পাল্টাতে হবে। কারণ, ছয় ঘণ্টা পর জমা রক্ত জীবাণুর বংশ বিস্তারের আদর্শ আধার হয়ে যায়। তখন শরীরের সঙ্গে থাকা জীবাণু মিলে প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটাবে। যাতে তাঁর প্রজননতন্ত্রের প্রদাহ তৈরি করে। পরে তলপেটে ব্যথা, স্বামীর সঙ্গে মেলামেশায় ব্যথা এবং সন্তান ধারণেও অক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে।

রেজাউল করিম বলেন, ছয় ঘণ্টা পর একজন চা–শ্রমিক যে তাঁর কাপড় পরিবর্তন করবেন, কর্মক্ষেত্রে সেটার জায়গা কোথায়? চা–বাগানে একবার কাজ করতে ঢুকলে তাঁর এসব ফুরসত নেই। আবার শুধু কর্মক্ষেত্র না, যে লেবারলাইনে তাঁরা থাকেন, সেখানেও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই।

নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার পরীক্ষা করার জন্য ভায়া (ভিজ্যুয়াল ইনসপেকশন অব কারভিক্স উইথ অ্যাকটিভ অ্যাসিড) টেস্ট করা হয়। জরায়ু ক্যানসার আছে কি না, এর প্রাথমিক শনাক্ত করার পরীক্ষা এটি। গত বছর হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম তিনটি চা–বাগানে ২০০ নারীর ভায়া টেস্টের ব্যবস্থা করে।

নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরামের আহ্বায়ক মার্জিয়া প্রভা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০ নারীর মধ্যে ৫০ জনেরই ভায়া পজিটিভ আসে। এই ২৫ জনের মধ্যে চা–শ্রমিক নারীদের আবার ঢাকায় এনে প্যাপস স্মিয়ার করা হয়। এখানে রিপোর্ট আসে যে পাঁচজন একেবারে ক্যানসারের দিকে। তাঁদের কল্পস্কোপিক বায়োপসি করতে হবে। যেখানে ক্যানসার কোনো পর্যায়ে আছে, তা নির্ণিত হবে। তবে সেটা আর করা হয়নি।

ফোরামের উদ্যোগে এরপর গত ডিসেম্বরে সিলেটের খাদিমনগরে ৫৭ জনের ভায়া টেস্ট করা হয়। ১৩ জনের ভায়া পজিটিভ এসেছে।

সিলেট নগরের কাছাকাছি থাকা চা–বাগানগুলোতে নারী চা–শ্রমিকদের কেউ কেউ প্যাড ব্যবহার করেন। কিন্তু অন্যত্র এই ব্যবহার একেবারেই কম।

মাসিককালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে নারী চা–শ্রমিকদের অসেচনতা ব্যাপক মাত্রায়। এ অসচেতনতা শুধু শ্রমিক নারীরা নন, স্কুল–কলেজে পড়া চা–বাগানের মেয়েদের মধ্যেও আছে। মার্জিয়া প্রভা এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেন। তিনি হবিগঞ্জ অঞ্চলের এক স্কুলশিক্ষার্থীর কথা বলেন। যে মেয়েটি প্রথমবারের মতো মার্জিয়ার কাছে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহারের বিষয়টি শোনে।

চা–বাগানের নারীদের সামাজিক সংগঠন চা–শ্রমিক নারী পরিষদ। সংগঠনটি নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরির জন্য সভা বা উঠোন বৈঠকের আয়োজন করে। এর সাধারণ সম্পাদক আশা আরনল বলেন, আমরা সচেতনতামূলক কথা বলি বটে কিন্তু এক নারী যে স্বাস্থ্যসম্মতসামগ্রী ব্যবহার করবে, সেই সামর্থ্য তাঁদের নেই। কর্মস্থলে পর্যাপ্ত পানি নেই, যে বাসাতে শ্রমিক থাকেন, সেখানকার পরিবেশও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শ্রমিকের আর্থসামাজিক উন্নতির দিকে দৃষ্টি না দিলে সুফল আসবে না।

অশিক্ষা, পানির সংকট, সচেতনতা এবং আর্থিক সক্ষমতার অভাব চা–শ্রমিক নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্যবিধিসহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির দৈন্যদশার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ওয়াটার এইডের বাংলাদেশীয় প্রধান হাসীন জাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নারীদের যেসব সমস্যা আছে, চা–বাগানে তার ভিন্নতা নেই। তবে এখানে আর্থসামাজিক অবস্থা যেহেতু অনেক বেশি খারাপ, তাই নারীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার চিত্রও বেশি নাজুক।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে প্রথম সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। আর বাংলাদেশেগত বছর নয় কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। চা উৎপাদনের ১৬৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয় গত বছর। দিন দিন চা চাষের পরিধি বাড়লেও এর সঙ্গে শ্রমিকের জীবন মানের উন্নতি নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এই অবস্থার পরিবর্তনে চা–বাগান মালিকদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের সার্বিক সুরক্ষার আলোচনার মধ্যে এটা আনা দরকার। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। চা–শিল্পে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁদের স্বাস্থ্যের দিকটি উপেক্ষিত কোনোক্রমেই হতে পারে না।