সময় কাটছে অর্থপূর্ণ

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার সেরিব্রাল পালসি আছে। তাই আমি হুইলচেয়ারে চলাচল করি। থাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিবিএ করেছি। এবার এ বিষয়ে একই জায়গা থেকে এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেব। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে করোনাকালের বন্দিজীবন আলাদা কোনো তাৎপর্য নিয়ে আমার কাছে আসেনি। সাধারণ দিনেরও বেশির ভাগ সময় আমাকে বাসাতেই থাকতে হতো। কারও সাহায্য ছাড়া আমি নিজে নিজে হুইলচেয়ার চালাতে পারি না। তাই অনেক সময়ই দু–তিন দিনও আমার একটানা বাসায় কেটে গেছে। একটুও বাইরে যাইনি।

এই করোনা-কালের বন্দিজীবনে সবার অবস্থাই এখন অবশ্য আমার মতো। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের দেখে বা ওদের কথা শুনে উপলব্ধি করি, ওরাও বুঝতে পারছে বন্দী থাকলে কী অসহনীয় লাগে। গৃহবন্দী প্রতিবন্ধীদের মনের দশা এখন তারা কিছুটা অনুভবে নেয়।

অন্যান্য সাধারণ দিনের বেশির ভাগ সময় আমি যেভাবে বাসায় কাটাতাম, এখনো সেভাবেই সময় কাটাই। বরং এখন আগের অন্যান্য দিনের চেয়ে আরও বেশি ব্যস্ত থাকছি। এমবিএ পরীক্ষার জন্য আমি পড়াশোনা করছি, কম্পিউটারে কিছু ফ্রিল্যান্সিং কাজ করছি, নামাজ পড়ছি, রোজা আসার পর থেকে কোরআন শরিফ পড়ছি। আমার বড় বোন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক। ওরা অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাস নেওয়ার জন্য আমার বোনের স্লাইড আমি তৈরি করে দিচ্ছি। বোনটির তিন বছরের ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে আছে। ওর সঙ্গে কথা বলছি আর খেলা করছি। এর বাইরে সকালে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রথম আলো পড়া আর টিভি দেখা তো আছেই।

আমি বরং বলব, আমার করোনা–কালের জীবনটা বেশ অর্থপূর্ণভাবেই কাটছে। এর মধ্যে এমন একটা ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি, যা আমার মনকে প্রসন্ন করেছে। আমরা আমাদের এলাকার যুবকদের সমন্বিত করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, এলাকার বিত্তশালীদের কাছ থেকে টাকা তুলে তহবিল গড়ে এখানকার ৬০টি দরিদ্র পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী উপহার দেওয়া। এ কাজে আম্মুও নানা পরামর্শ দিয়ে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।

আমার কাছে মনে হয়, বর্তমানকালের মতো সময়ে নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা। আমিও সেটাই করছি।

আমার আব্বু একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বেশ ধার্মিক মানুষ। নামাজের সময় মসজিদ ছাড়া উনি কিছু বোঝেন না। কিন্তু করোনার কারণে তো মসজিদে মানুষের যাওয়া সীমিত হয়ে পড়ল। তখন আব্বুসহ মসজিদে না যেতে পারা অন্যান্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আমার মন খারাপ হতো। আমার নিজের খারাপ লাগত, বিশেষ করে শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য মসজিদে যেতে পারতাম না বলে।

২৮ মার্চ থেকে আমাদের এমবিএ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেটা তো আর শুরু হতে পারল না। এমনিতেই আমরা দুই বছরের সেশনজটে ছিলাম। সে জট এখন আরও বাড়ল। অন্যান্য চাকরির পরীক্ষাগুলোও স্থগিত হয়ে আছে। মানুষ নিয়োগ দেবে কী, এখন আছে ছাঁটাই করার ভাবনায়।

আমাদের মতো মানুষের অবস্থা বিশেষভাবে খারাপ। এমনিতেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটা নেই, আর থাকলেও সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। করোনার কারণে অন্যান্য চাকরির পরীক্ষার দরজায়ও কপাট পড়েছে। যাঁদের বয়স শেষ হতে চলেছে, সরকার এখন তাঁদের চাকরি দেবে নাকি প্রতিবন্ধীদেরও একই অবস্থা হবে? এখানে সরকারকেই বা কী দোষ দিই। আমাদের দেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণেই এই অবস্থা।

এসব ভেবে ভেবে আমার দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। মাঝেমধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভাবি, আমার ভবিষ্যৎ নিয়তি যে এঁকেবেঁকে কোন দিকে ছুটল? হয়তো কখনো আর চাকরিই পাব না। সারা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে হয়তো শিক্ষিত বেকার হয়ে।

এসব নানা কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আবার আরেক মনে ভাবি, এমন বিপদ তো মানুষের শেষ নিয়তি কখনোই হতে পারে না। মানুষ সেসব অতিক্রম করে এসেছে। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই সহায় হবেন।