'ধানোত কেবল পাক ধরছে, পানি আসি সউগ ডুবি গেইল'

উজানের ঢলে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছেন কৃষকেরা। আজ শনিবার সকালে কুড়িগ্রামের চিলমারীর রানীগঞ্জ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
উজানের ঢলে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছেন কৃষকেরা। আজ শনিবার সকালে কুড়িগ্রামের চিলমারীর রানীগঞ্জ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

‘অনেক কষ্টে ট্যাকা জমে এক বিঘা জমি আদি নিয়া বোর আবাদ করি। ফলন ভালো হইছে। ধানোত কেবল পাক ধরছে। হঠাৎ বানের পানি আসি সউগ ডুবি গেইল। এ্যালা চলমো কেমন করি। খাম কী?’

কোমরপানিতে নেমে ধান কাটতে কাটতে কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর নুরুদ্দিন। বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের প্রথম আলো চরে। জেলার ১৬টি নদ-নদীর তীরবর্তী শতাধিক চরের মানুষের এখন নুরুদ্দিনের মতো অবস্থা। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হঠাৎ চরাঞ্চলের অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলের জমির ধান-পাটসহ অন্যান্য ফসল ডুবে গেছে। কৃষকেরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আধা পাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন।

আজ শনিবার সকালে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের দুধকুমার নদের পূর্ব পারে প্রথম আলো চর, চর রাউলিয়া, রসুলপুর, যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটা, খাসের চর, গোয়ালপুরী, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের আইরমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর, চর কাফনা, কালীগঞ্জ ইউনিয়নের কাঠগিরাই চরে গিয়ে দেখা যায়, ধানের জমিগুলোতে পানি উঠেছে। কৃষকেরা বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও বুকসমান, কোথাও কোমরপানিতে নেমে কাঁচা-পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় চর গোয়ালপুর, রলাকাট খাসের চরে গিয়ে দেখা যায়, নদ ফুলেফেঁপে উঠেছে। চিলমারীর রানীগঞ্জ এলাকার কয়ারদোলা, সৈলধুগরি, মুনগি বিল এলাকার ধানও পানিতে তলিয়ে গেছে।

রাউলিয়ার চলের মোশারফ হোসেন ধান কেটে ছোট নৌকায় করে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সর্বনাশ হয়া গেল, ভাই। ধান কেবল পাকপার ধরছিল। ফলন খুব ভালো হইছিল। ডুবি গেইছে। এগলা ধান থাকি চাউল হবে না। চিটা হবে। কাটি নিয়া যাবার নাগছি গরুক খাওয়ামো।’

গোয়ালপুরী চরের জেলে মো. আলম জানান, নদীতে মাছ ধরে কোনোরকমে তাঁর সংসার চলে। দেড় বিঘা জমিতে বোরো-২৯ ধান লাগিয়েছিলেন। সব ডুবে গেছে। রলাকাটার কৃষক আনছার আলী ও আবদুর রহমান বলেন, চরাঞ্চলে জমিতে বোরো ধান দেরিতে লাগানো হয়। কাটা হয় সবার শেষে। এই সময় এমন পানি তাঁরা দেখেননি। ধান, পাট, সবজি সব ডুবে গেছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার চর কাফনার আবদুর রহিম বলেন, চরের ৯৫ ভাগ মানুষ দিনমজুর, জেলে। করোনার সময় সবাই বাড়িতে বসে। কাজ নেই। কষ্টে আছেন। এর মধ্যে ঝড়, শিলাবৃষ্টি ফসলের ক্ষতি করে গেল। এখন আসছে পানি। ধান ডুবিয়ে দিল। চরের মানুষের কষ্ট কেউ দেখতে এল না।

উজানের ঢলে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছেন কৃষকেরা। আজ শনিবার সকালে কুড়িগ্রামের চিলমারীর রানীগঞ্জ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
উজানের ঢলে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছেন কৃষকেরা। আজ শনিবার সকালে কুড়িগ্রামের চিলমারীর রানীগঞ্জ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, চরাঞ্চলের মানুষ দেরিতে ধান কাটেন। তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছেন। আম্পানের পর থেকে এখন পর্যন্ত জেলায় কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, গত এক সপ্তাহে নদ-নদীর পানি বেড়েছে ১০ থেকে ১২ ফুট। গত দুই দিন পানি বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। চরে নিচু এলাকায় পানি উঠেছে। আশা করছেন দ্রুতই কমে যাবে।