সব কর্মীকে একসঙ্গে কাজে ফেরানো যাবে না

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা কর্মস্থলে পুনরায় কাজ শুরুর আগে কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। সংস্থাটি বলছে, সব ধরনের ও সব আকারের প্রতিষ্ঠানকেই এসব নির্দেশনা মানতে হবে। নির্দেশনা অনুসারে, সব কর্মীকে একসঙ্গে কাজে ফেরানো যাবে না। কোন কর্মীরা আগে কাজে ফিরবেন, তা সবার আগে নির্ধারণ করতে হবে।

আইএলও ৭ মে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কর্মীদের জন্য ‘নিরাপদে কাজে ফেরা’ শীর্ষক একটি নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার নেওয়া স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরামর্শের ভিত্তিতে তা তৈরি করা হয়েছে। এটি মূলত সংক্রমণের ঝুঁকি যতটা সম্ভব কমিয়ে কর্মীদের নিরাপদে কর্মস্থলে ফেরানোবিষয়ক নির্দেশনা।

আইএলওর নির্দেশনার বলা হয়েছে, কোন কর্মীরা আগে কাজে ফিরবেন প্রতিষ্ঠানকে সবার আগে তা নির্ধারণ করতে হবে। যাঁরা ঘরে থেকে কাজ চালিয়ে নিতে পারছেন, তাঁদের ঘরে থেকেই কাজ করতে হবে। পুনরায় কাজ শুরুর আগে কর্মস্থলে সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা, তা মূল্যায়ন করতে হবে। কর্মস্থলকে কাজে ফেরার উপযোগী করতে হবে। লকডাউন (অবরুদ্ধ অবস্থা) বা সাধারণ ছুটির পর প্রতিষ্ঠানের পুনরায় কাজে ফেরার পরিকল্পনা ও পদ্ধতি সম্পর্কে কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ বিষয়ে কর্মীদের সচেতন করতে হবে। কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের কাজে ফেরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

আজ রোববার থেকে সীমিত আকারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত খুলছে। সীমিত পরিসরে খোলার কথা বলা হলেও সব কর্মী উপস্থিত হলে অফিসে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধির কতটুকু মেনে চলা সম্ভব হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আইএলওর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও অফিস-আদালতে বেশ কিছু নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছে। এর মধ্যে অফিসে কাজ করার সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। দেশে সংক্রমণ বাড়ার মধ্যে সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, ছুটি বা লকডাউন তুলে নেওয়ার কিছু পূর্বশর্ত আছে। সংক্রমণ কমে যাচ্ছে সেটি প্রমাণিত হতে হবে। অথচ, দেশে সংক্রমণ বাড়ার সময় সব খুলে দেওয়া হচ্ছে। এই সময় অফিস-আদালতে স্বাস্থ্যবিধি আরও কঠোরভাবে মানতে হবে। এগুলো ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা অফিসের ভেতরে-বাইরে থেকে তদারক করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানাতে না পারলে বিপদ আরও বাড়বে।

ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আকরামুল হকের অফিস দুই মাস পরে আজ রোববার খুলছে। সব কর্মীকে অফিসে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই এত দিন বাসায় থেকে কাজ করেছেন। অফিস খোলার পরে কর্মীদের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। শুধু কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে।

নিরাপদে কাজ শুরুর ক্ষেত্রে কয়েক ধাপে কর্মীর সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে আইএলওর নির্দেশনায়। কর্মীর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন করা, কর্মস্থলে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা, কর্মীদের বাসা থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গণপরিবহন ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা, কর্মস্থলে প্রবেশের আগে উপসর্গ পরীক্ষা করা অন্যতম। কোনো কর্মীর বাড়ির সদস্যদের কেউ আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) থাকলে তাঁকে কাজে আসতে মানা করতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, জনগণকে অনেক দিন ধরে সচেতন করা হচ্ছে। অফিস-আদালতে নিজস্ব কর্তৃপক্ষ রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে। পদে পদে চোখে রাখার মতো লোকবল সরকারের নেই। তবে নির্দেশনার অমান্যতা চোখে পড়লে বা প্রতিপালন না হলে সরকার যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে।

আইএলও বলছে, কর্মস্থলে ফেরা কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে দৈনিক নিজের কনটাক্ট লগ বা সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। সারা দিনে কর্মস্থলের কোন কোন সহকর্মীর কাছাকাছি গেছেন বা সংস্পর্শে এসেছেন, সেটি লিখে রাখতে হবে। এর ফলে অফিসের কেউ করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হলে তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। অতি জরুরি না হলে অফিসে সভা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সভা করলে উপস্থিতি নিবন্ধন করতে হবে।

একটি আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শামিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে সব কর্মীকে মাস্ক, গ্লাভস পরতে বলা হয়েছে। আর অফিসে নিয়মিত হাত ধুতে বলা হয়েছে। এর বাইরে বিশেষ কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি কী কী মানতে হবে, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ৮ মে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কারিগরি নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়, অফিস খোলার আগে মহামারি প্রতিরোধী সামগ্রী (মাস্ক, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী) সংগ্রহ করতে হবে। আপৎকালীন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ঘন ঘন সংস্পর্শে আসা জায়গা (যেমন দরজার হাতল, লিফট ও শৌচাগারের সারফেস) নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। কর্মীদের জন্য দৈনিক স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণের বিস্ফোরণ না ঠেকাতে পারলে দেশ সব দিক দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে যাবে। যেসব প্রতিষ্ঠান খুলছে তাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি সরকারকে সমন্বয় করতে হবে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনকেও কাজে লাগাতে হবে।