লকডাউন ও একটি করলাগাছ

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সেদিন প্রতিদিনের মতোই ছুটির পর স্কুল গেটে বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবা এসে বললেন, ‘তিনজন করোনা রোগী পাওয়া গেছে।’ শুনে ভয় পেয়েছিলাম তা নয়, নির্বিকারভাবে বাবার সঙ্গে বাসায় এলাম, শুধু বাসায় ঢোকার আগে বাবাকে বললাম, ‘বাবা, সামনের দোকানে স্যানিটাইজার আছে কি না দেখো তো?’ ভাগ্য ভালো ছিল। দোকানের শেষ স্যানিটাইজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

তারপর একের পর এক লকডাউন, আক্রান্ত রোগী আর মৃত্যুর মিছিল, নিম্নবিত্তের আহাজারি, মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাস, লকডাউন উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়া মানুষের জীবিকার সন্ধান; এসব খবরে সাধারণ মানুষ হিসেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এসব বাস্তবতায় আমাদের জীবনের একমাত্র উচ্ছ্বাসের জায়গা হয়ে উঠেছিল বাসার ব্যালকনিতে পুরোনো বালতিতে বেড়ে ওঠা করলাগাছটি।

করলাগাছটি বেড়ে চলল, একে একে সে ব্যালকনির গ্রিল আঁকড়ে ধরে মেলে দিল তার সবুজ পাতা। একসময় হলুদ ফুলে ভরিয়ে দিল ছোট ব্যালকনি। দিন শেষে দেখতাম কিছু ফুল ঝরে যায়...আর কিছু থেকে যায়। মা আমাকে ফুলগুলো দেখিয়ে বলতেন, ‘দেখিস এই ফুলটা থেকে করলা হবে, ওটা থেকে বোধ হয় হবে না...।’ একসময় করলাও এল, কিন্তু শুরু হলো পোকার আক্রমণ। প্রকৃতির নিয়মের আশ্চর্য মিল...করলা নাস্তানাবুদ পোকার আক্রমণে...আর মানুষ করোনাভাইরাসে।

এখন সেই গাছ আর আগের মতো নেই...পাতায় তার হলদেটে ভাব...ফুলগুলো ফ্যাকাশে হয়ে ফোটে; মনে হয় গাছটি ঠিক যেন নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের জীবনগাথা—প্রবহমান জীবনে চলতে কষ্ট হলেও টিকে থাকা যায়। কিন্তু জীবনের প্রবাহ থেমে গেলে জীবন আর স্বপ্ন দুটোই থেমে যায়।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জীবনে চলার সম্বল বাবার বেসরকারি চাকরি। লকডাউন তুলে দেওয়ায় মানুষ ছুটছে জীবিকার তাগিদে, জীবনটা হাতে নিয়ে। বাবা ১৬ বছর শ্বাসকষ্টকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছেন। এখন প্রশ্ন, কোনটা আগে, জীবিকা নাকি জীবন? আমার বাবার মতো শারীরিক জটিলতা নিয়ে অনেকেই বেঁচে আছেন, তাঁরাও অনেকের বাবা। কিন্তু এ সময়ে কোনো বিপদ হলে আমরা সাধারণ মানুষ কি আদৌও টিকে থাকতে পারব? নাকি সেই করলার ফুলের মতো ঝরে যাব?

জীবন আর জীবিকার প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের পরিবারের মতো অনেক পরিবার। অনেকে হয়তো জীবিকাকে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের অনেকেরই প্রকৃতির আশীর্বাদে কোনো শারীরিক জটিলতা নেই। কিন্তু যাঁরা অনেক পুরোনো রোগ নিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা কি পারবেন টিকতে?

এ প্রশ্নের কি কোনো উত্তর আছে? নাকি এর উত্তর শূন্যের মতো অসঙ্গায়িত? কিন্তু অসঙ্গায়িত বললে তো চলবে না, কারণ চাকরিও তো বাঁচাতে হবে, তা–ও জীবনেরই প্রয়োজনে। অফিসের বড় কর্তা বলছেন তাঁর প্রয়োজনে, কিন্তু তাঁর নিজের অলক্ষে বলা একটা কথা একটা পরিবারের নির্ঘুম রাতের কারণ হতে পারে। তিনি হয়তো তা নিজেও জানেন না অথবা তাঁর মন অবিশ্বাস নামক ভাইরাসে আক্রান্ত। যার কারণে আমরা মধ্যবিত্তরা পুরোনো রোগ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ আজ এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। সেটা হলো, জীবন নাকি জীবিকা?

আর লিখতে চাই না। আমি বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চা হয়েই থাকতে চাই। অবরুদ্ধ ঘরে বসে প্রতি মুহূর্তের প্রতীক্ষা, জানালার ধারে তাকিয়ে থাকি, কবে আবার বই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতে পারব।


* দশম শ্রেণি, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা। [email protected]