বানিয়ারচর ট্র্যাজেডি: এখনো শুরু হয়নি বিচারকাজ

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর ক্যাথলিক গির্জায় বোমা হামলা ট্র্যাজেডি দিবস আজ ৩ জুন। ২০০১ সালের এই দিনে ভয়াবহ বোমা হামলায় গির্জায় প্রার্থনারত খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ১০ জনের প্রাণ নিভে যায় এবং আহত হয় অর্ধশত মানুষ। এ হত্যাকাণ্ডের ১৯ বছর অতিবাহিত হলেও সম্পন্ন হয়নি বিচারকাজ। ফলে হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও স্বজনেরা।

অন্য বছরের মতো এ বছরও বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে গির্জায় নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনায় ও স্মরণে সকাল সাতটায় গির্জায় প্রার্থনাসভা, সমাধিতে মঙ্গলজল ও ফুল ছিটানো। সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালন। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর অনুষ্ঠানসূচি সীমিত করে বাদ দেওয়া হয়েছে আলোচনা সভা, কাঙালি ভোজ ও আলোক মিছিল।

বোমা হামলায় নিহত সঞ্জীবন বাড়ৈর বাবা বিজেন্দ্র বাড়ৈ বলেন, ‘আমরা এখন ক্লান্ত। সেই ২০০১ সাল থেকে বিচার চেয়ে আসছি। কিন্তু কেউ আমাদের দাবি শোনে না। এই বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, খাইয়া না-খাইয়া বাঁইচা আছি। এখন আর কেউ হাওলাদও দিতে চায় না।’ তিনি বলেন, ‘ছোয়ালডা (ছেলে) বাঁইচা থাকলে হয়তো এত কষ্ট করতে হতো না। ছোয়ালডা মরল, তার বিচারডাও পাইলাম না। দেশে কত বিচার হচ্ছে। আমাগো বিচারডা কী দোষ করছে? বিচারডা হইলে মইরাও শান্তি পাইতাম।’

নিহত সুমন হালদারের বাবা সুখরঞ্জন হালদার মনে করেন, তাঁর ছেলেও যিশুখ্রিষ্টের মতো একদিন পুনর্জন্ম নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে আসবে। প্রতিদিনই দু-একবার ছেলের ছবি সামনে নিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে স্মৃতিচারণা করে চোখের পানি ফেলেন। একমাত্র সন্তানকে হারানোর পর তিনি হৃদ্‌রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত।

সুমনের মা আন্না হালদারও অসুস্থ। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলে মারা যাওয়ার পর সরকারি অনুদান মেলে এক লাখ টাকা। সেই টাকা ব্যাংকে রেখেছেন। প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে আসে ৮০০ টাকা আর গির্জা থেকে সাহায্য দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। একখণ্ড জমি আছে, তাতে যে ধান হয়, তা দিয়ে চলছে দুজনের জীবনযুদ্ধ। ওষুধ কেনার পর খাওয়ার জন্য থাকে সামান্য কিছু টাকা। তাই দিয়ে কোনোমতো চলছে সংসার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আন্না হালদার বলেন, ‘১৯ বছর পার হলো। কিন্তু আমার ছেলের হত্যার কোনো বিচার হলো না। আমি মরার আগে যেন ছেলে হত্যার বিচারটা পাই, সরকারের কাছে সেই দাবি জানাই।’

শুধু সুমন ও সঞ্জীবনের পরিবার নয়, এই অবস্থা বোমা হামলায় নিহত অপর আটটি পরিবারেরও। নিহত ঝন্টু মণ্ডলের মা ননী মণ্ডল, মাইকেল মল্লিকের মা জয়ন্তী মল্লিকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেন, তাঁরা তো বছরের পর বছর অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু সরকার তো ভালোমন্দ কিছু বলে না। তাঁদের একটাই দাবি, দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করে দোষীদের ফাঁসি দেওয়া।

বানিয়ারচর ক্যাথলিক গির্জার দায়িত্বরত ফাদার জরেন রিংকু গমেজ বলেন, ধর্মীয় মতে প্রতিবছর এই দিনে তাঁরা প্রার্থনাসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকেন। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে সেসব কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। তবে সরকার বা জাতির কাছে তাঁদের একটাই দাবি, এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নৃশংস হত্যার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা।

যোগাযোগ করলে গোপালগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সুভাষ চন্দ্র জয়ধর বলেন, মামলাটি এখন সিআইডির কাছে তদন্তাধীন। তারা দ্রুত তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে বিচারকাজ শুরু হবে।

এ বিষয়ে সিআইডির গোপালগঞ্জ ক্যাম্প ইনচার্জ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক ফতেহ মো. ইফতেখারুল আলম বলেন, বানিয়াচরের ঘটনায় দুটি মামলা রয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। তার আগে ২১ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর এই মামলার তদন্তকাজ গুরুত্ব দিয়ে করছেন। কিছু আসামি বিদেশে পলাতক থাকায় আইনগত একটু সমস্যা রয়েছে। তারপরও যত দ্রুত সম্ভব মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার চেষ্টা চলছে।