লকডাউনে গৃহ পুলিশ ব্যবস্থাপনা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

খালি অজুহাত খুঁজি। বাসা থেকে কী করে বের হব, সেই অজুহাত। কোনোটাই কাজে লাগে না। বউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে বাসায় সব আছে। অন্য সময় হলে সে লাঠিচার্জ করত, ‘চার দিন হলো বাজারে যাও না। আমি কি তোমাকে নিজের রক্ত-মাংস সিদ্ধ করে খাওয়াব?’ আর এখন তার উল্টো।

প্রথম প্রথম মনে হতো করোনা স্বামীদের পক্ষেই আছে, যা বলি বউ তা–ই শুনে। সারাক্ষণ যত্ন নেয়। বাজারে যেতে বলে না। বেসিনের ট্যাব ঠিক করো; আবহাওয়া মেজমেজে, বাচ্চারা পোলাও খাবে, তিন কেজি পোলাওর চাল নিয়ে আস; মেয়ে আচার খেতে চাচ্ছে, একটা ভালো দেখে আচারের বয়াম নিয়ে আসো; ভাবি তিন দিন ধরে ফোন দিচ্ছে, চল আজ ঘুরে আসি; শুনছ? তোমার ছেলে বলছে সে পড়তে পারবে না, তার নাকি ঘুম ঘুম লাগছে, চল না তাকে নিয়ে চাঁদনি রাতে মাঠ থেকে ঘুরে আসি; এমন নানান তাগিদে কম করে হলেও ১০ বার বাইরে যেতে হতো। মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগত। আর আজ নিজেই ছুতো খুঁজি। বাইরে যাওয়ার ছুতো। তবু সুযোগ পাই না।

‘কী গো, বাজারে যেতে হবে না?’

‘না, সব আছে।’

কী বলে এসব! ১০ দিন হলো বাজার করলাম, আজকেও বলে সব আছে। এত বরকত! কোন ফেরেশতায় সব দিয়ে যায়! ইদানীং খাবারের সময় ফ্রেশ তরকারি পাই। জিজ্ঞেস করলেই বলে ফেরেশতা দিয়ে গেছে। সম্ভবত দুধওয়ালা সেই ফেরেশতা। আমি ঘুম থেকে দেরিতে উঠি বলে টের পাই না। যাহোক, চলছে সেই ভালো। কিন্তু আমার বের হওয়ার রাস্তা কী? ভেবে দেখলাম বড়গিরি একমাত্র ভরসা। তাকে ফোন দিলাম। বড়গিরি মানে বউয়ের বড় ভাই। আমরা একই শহরে থাকি। বড়গিরি হলেও সে আমার বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে পড়তাম। শালা, বিয়ের পর ভাইজান সেজেছে।

‘ভাইজান কী খবর?’

‘খবর ভালো না। বউ বের হতে দেয় না।’

‘আমিও তো একই সমস্যায় আছি। চলেন বউ ছেড়ে দিই।’

‘বউ ছেড়ে দিবা ভালো কথা। কিন্তু আব্বারা যদি কেস করে দেয়। এমনিতেই করোনায় খুঁজে, পরে আবার পুলিশেও দৌড়াইব। এ সময়ে ঝামেলায় যাবার দরকার নাই। বরঞ্চ, কেমনে বের হওয়া যায়, তার বুদ্ধি বের কর।’

‘আম্মারে কন আমারে দাওয়াত দিতে। মেলা দিন ধরে আপনাদের বাসায় যাই না।’

‘তোমাকে আসতে দিলে তো ভালোই ছিল। এই অসিলায় তোমার বিদায়বেলা আমিও বের হতে পারতাম। সমস্যা হলো, আম্মাও এখন বউয়ের মতো কথা বলে। বলে, “রতন সাদা চামড়ার মানুষ। সাদা চামড়া দেখলে করোনার নাকি হুঁশ থাকে না। করোনা নামটা মেয়েলি। স্বভাবটা পুরুষের মতো, তাই না?”’

‘ভাইজান আমিও একই সমস্যায় আছি। আপনের বইনে বলে, “ভাইজান রে বাসায় আসতে বলবা না। কালা মানুষ, গায়ে চুনের দাগ ছাড়া কিচ্ছু ভাসে না। গায়ে করে করোনা নিয়ে আসলেও বুঝবা না।”’

‘তুমি কি আমারে খুঁচা দিলা?’

‘কী যে বলেন, আপনারে খুঁচা দিব কেন? দিছিলাম আপনের বইনে রে। তারে কইলাম, করোনায় এত মানুষ মরে, তোমার বাপ-ভাই রে ধরে না। তাইলে তো দেখতে যেতে পারতাম।’

‘ভাব নিচ্ছ না? আমার করোনা হইলে তোমারে ছাড়তাম না, আইসা ঝাবুইত্তা ধরবাম।’

‘তাইলে বাসায় থাকেন। বের হওয়ার দরকার নেই।’

‘তুমিও তো দেখি বউয়ের মতো কথা বলছ। আচ্ছা, একটা বুদ্ধি বের কর। বের হই। তোমারে অইডা খাইতে দিমুনে।’

‘খেয়ে তো বুকটা ঝাঁজরা বানায়া ফেলছ। তোমার জন্য আমার বুকটাও শেষ। তবে আজকের পর আর না।’

‘লাইনে আসছে মনে হয়। ইদানীং খুব বড়গিরি ভাব ধরে। নিজে লুকায়া লুকায়া খায়, কিন্তু আমারে অইডা খাইতে দেয় না। মনে হয় বউ কিছু শিখায়ে দিছে। যাহোক, এখন ঝগড়া করা যাবে না। বের হওয়ার একটা বুদ্ধি বাতলাতেই হবে।’

‘আমার বউকে আপনি ফোন দিয়ে বলেন, জরুরি কথা আছে, আমারে যেন পাঠিয়ে দেয়। আর আমি আপনার ময়নাকে ফোন দিয়ে একই কথা বলি।’

ময়না হলো বড়গিরির বউ। স্কুলে আমাদের নিচের ক্লাসে পড়ত। ছাত্রজীবনে লাইন দিয়েছি। পাত্তা পাইনি। সেই ক্ষোভ এখনো আছে। তাই ভাবি ডাকি না। ময়না বলেই ডাকি। আগের পরিচিত, কেউ কিছু বলতেও পারে না।

‘তুমি তোমার বউকে বলো। আমি আমার বউকে বলি। এইটাই সহজ পদ্ধতি।’

‘ভাইজান এই ভুল করবেন না। কাজটা সহজ হতে পারে, সফল হবেন না। তাদের নিজে যেয়ে যতই বলেন বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি আপনার ময়নাকে আর আপনি আমার ময়নাকে বললে ফেলতে পারবে না।’

‘ঠিকই কইছ। আছি তাই করছি। তুমি রেডি হইয়া আরামবাগের মোড়ে আস।’

এই সুযোগ, যদি ওপরওয়ালা মুখ তোলে তাকায় আর কি!

* অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। [email protected]