করোনার সঙ্গে আম্পানের আঘাতে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা বিপর্যস্ত

শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা
শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা

রাজধানীর শাহবাগের ফুলের বাজার সবারই চেনা। তবে সেখানে আগের চেনা দৃশ্য আর নেই। অধিকাংশ দোকানই বন্ধ। দোকানে দোকানে মালা গাঁথা, স্তবক সাজানোর ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। ‘ভাই-বোন’ নামের ফুলের দোকানের মালিক মো. সুমন শুক্রবার দুপুরে জানালেন, তখন পর্যন্ত তাঁর কোনো বিক্রি হয়নি। বৃহস্পতিবার মাত্র আড়াই শ টাকা বিক্রি হয়েছে।

সুমন যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ১০ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। ছেলে–মেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিন মাস ধরে আয় নেই। দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন যাচ্ছে।

করোনাভাইরাসের কারণে গত প্রায় তিন মাস সারা দেশে ফুলের দোকান ছিল বন্ধ। তারপর গত মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত। দেশের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাঁদের। এখন দোকান খুললেও বেচাকেনা নেই বলেই চলে।

সারা দেশে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের ২৬টি সংগঠনের সম্মিলিত কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন বললেন, তাঁদের মেরুদণ্ডই যেন ভেঙে গেছে। ‘পথের ফকির’ হয়ে পড়েছেন শত শত ক্ষুদ্র চাষি ও ব্যবসায়ী। সরকারঘোষিত প্রণোদনার ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জটিলতার কারণে ফুলচাষিরা ঋণ পাচ্ছেন না বলেও তাঁদের অভিযোগ।

টানা প্রায় ৬৬ দিন লকডাউনের পর গত ৩০ মে থেকে সারা দেশে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। রাজধানীতে ফুলের প্রধান পাইকারি ও খুচরা বাজার শাহবাগে। এ ছাড়া আরেকটি বড় পাইকারি বাজার রয়েছে আগারগাঁওয়ে। শাহবাগে খুচরা দোকান ৫১টি। আজ শুক্রবার এখানে দেখা গেল মাত্র ৭টি দোকান খোলা। অনিকা পুষ্পবিতানের মালিক ও শাহবাগ ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বললেন, দোকান খুললেও বিক্রি হচ্ছে না। একদিকে ক্রেতা নেই, অন্যদিকে ফুলও আসছে না। সামাজিক অনুষ্ঠানাদি শুরু না হলে ফুলের ব্যবসা হবে না।

শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা
শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা

শাহবাগের ফুলের বাজারে প্রতি দোকানে রোজ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হতো। এখন সারা দিনে এক হাজার টাকাই বিক্রি হয় না। এরা সবাই ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ী। এক-দুই লাখ টাকার মূলধন। ফুল পচনশীল কাঁচা পণ্য। রোজ বিক্রি করে রোজ আয়। তাই দিয়ে সবার সংসার চলে। ঢাকায় এখন খুচরা ও পাইকারি মিলিয়ে ফুলের দোকান প্রায় সাড়ে ছয় শ। এসব দোকানে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হয়। এখন ব্যবসা বন্ধ থাকায় অনেকেই তাঁদের পুঁজি ভেঙে খেয়ে কালামের ভাষায় ‘ফতুর’ হয়ে গেছেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আবদুর রাহিম ও সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন জানালেন, দেশের কাঁচা পণ্যের মধ্যে ফুলের বাজারের সরকারি কোনো সহায়তা নেই। চাষি ও ব্যবসায়ীরাই নিজ উদ্যোগে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। দেশে ক্রমশ ফুলের চাহিদা বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়া, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে অল্প কিছু পরিমাণে ফুল রপ্তানি হচ্ছে। রজনীগন্ধা এবং গ্লাডিওলাসই বেশি যাচ্ছে। জারবেরারও চাহিদা আছে। তবে উন্নত প্রযুক্তি সহায়তা না থাকায় বিদেশে তেমন রপ্তানিতে সুবিধা করা যাচ্ছে না।

সোসাইটির নেতারা জানালেন, ২০১৯ সালে ফুলের ব্যবসা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। প্রতি মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত তিন মাসে ৪৫০ কোটি টাকার ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুলের ব্যবসার প্রধান মৌসুম। গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা ও মল্লিকা—এই ছয়টি ফুলের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন মৌসুমে ডালিয়া, দোলনচাঁপা, কসমস, ক্যালেন্ডুলাসহ ৩০টি বেশি ধরনের ফুলের চাষ হয়ে থাকে। দেশে এক দিনে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় পয়লা বৈশাখে। এদিন ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার ফুল কেনেন পুষ্পানুরাগীরা। এ ছাড়া ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১০ মে মা দিবসেও ভালো বেচাকেনা হয়। এই তিনটি বড় উপলক্ষ এবার মার খেয়েছে। যে অবস্থা চলছে, তাতে কবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব শুরু হবে, তা ঠিক নেই।

এই পরিস্থিতির মধ্যে আবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানে যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা এলাকার ফুলের জমির শেডগুলোর মাটি সমান হয়ে গেছে। কেবল ২০০ বিঘা জমির জারবেরার শেড সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এক বিঘা জমিতে জারবেরার চাষ করতে ন্যূনতম ১২ লাখ টাকা খরচ হয়। ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাবে আম্পানের আঘাতে ফুলচাষিদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনা ও আম্পানে ফুল ব্যবসার ক্ষতি প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা।

শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা
শাহবাগের ক্রেতাশূন্য ফুলের দোকান। ছবি: হাসান রাজা

ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাবে দেশে এখন ২৯টি জেলায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। ফুল চাষের প্রধান এলাকা যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গায় চাষ হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টরে। এ ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, নাটোর, কক্সবাজারসহ ২৬ জেলার চাষ হয় আড়াই হাজার হেক্টরে। সোসাইটির তালিকাভুক্ত মোট ফুলচাষি প্রায় ২০ হাজার। এ ছাড়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক মিলিয়ে ফুল ব্যবসায় মোট জনবল প্রায় ২২ লাখ। অত্যন্ত দুর্দিন যাচ্ছে তাঁদের।

ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতারা জানালেন, সরকার করোনার প্রণোদনা হিসেবে কৃষি খাতে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ফুল, ফল, মসলা, মৎস্য ও পোলট্রি—এই পাঁচ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বিনা জামানতে চাষিদের ঋণ দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে জামানতের বিষয়টি এবং বর্গাচাষিদের কথাও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে একেক রকম নিয়ম অনুসরণ করছে। ন্যূনতম ৩ একর জমি যাদের আছে তাদের মাত্র ৩৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ফুলচাষিদের অধিকাংশই বর্গাচাষি। তাঁরা এই প্রণোদনার সুবিধা পাচ্ছেন না। প্রণোদনার ক্ষেত্রে সৃষ্ট এই জটিলতার অবসানের জন্য তাঁরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।