করোনা মোকাবিলায় দরকার পুরো সমাজের অংশগ্রহণ

মোশতাক চৌধূরী
মোশতাক চৌধূরী

তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থা তছনছ করে কোভিড-১৯ এখন স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঘাঁটি গাড়ছে। প্রতি ১০০টি নতুন আক্রান্তের মধ্যে ৭৫টি ঘটছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। করোনাগ্রস্ত শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে এখন বাংলাদেশের অবস্থান।

সবশেষ সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬৩ হাজারের বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশারদদের মতে, এটা আসল সংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’। অন্তত দুটি কারণে আমরা আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা পাচ্ছি না। এক, পরীক্ষাগারের স্বল্পতা। বাংলাদেশে এখন ৫০টি পরীক্ষাগার আছে যার প্রায় সব কটিই রাজধানীসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে। অর্ধেক জেলাগুলোতেই করোনা পরীক্ষা সহজলভ্য নয়। দুই, যাঁরা পরীক্ষা করতে আসছেন তাঁদের সবার মধ্যে করোনার বিভিন্ন উপসর্গ উপস্থিত। উপসর্গবিহীন সম্ভাব্য রোগী বা এসিম্পটোমেটিক কেস পরীক্ষা করাতে আসছেন না। করোনার প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে তাই আমাদের জনসংখ্যাভিত্তিক নিবিড় জরিপ চালাতে হবে। সম্প্রতি পাকিস্তানের লাহোরে চালানো একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে যে মূল সংখ্যার ২৫ ভাগের ১ ভাগ (অর্থাৎ ৪ শতাংশ) মাত্র বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে ধরা পড়ছে।

জোনিংয়ের ভিত্তিতে দেশটিকে এখন তিনটি ভাগে ভাগ করা হবে। দেরি করে হলেও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এই কৌশল বা স্ট্র্যাটেজির সফলতা নির্ভর করবে কীভাবে এটা বাস্তবায়িত হবে। জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই জোনিংয়ের ওপর কাজ করছেন। জেলাভিত্তিক উপাত্তের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে পাওয়া ফলাফলে দেখা যায় যে বাংলাদেশে বর্তমানে ১০টি জেলা লাল জোনে, ২৮টি হলুদ জোনে এবং ২৬টি সবুজ জোনে অবস্থিত। এর মধ্যে সরকারিভাবে শুধু কক্সবাজারকে ‘লাল’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জেলাগুলো খুবই ‘পরাস’, অর্থাৎ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় অতি সহজেই যাতায়াত করা যায়। সরকার ইতিমধ্যে জনপরিবহন খুলে দিয়েছে। অধিক জনসংখ্যার এই দেশে কীভাবে গাদাগাদি করে মানুষ এসব পরিবহনে চলাচল করে, তা সর্বজনবিদিত। শুধু একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থান এসব বাসের সবাইকে নিমেষে আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। বলা হয় যে দক্ষিণ কোরিয়ায় সেই করোনায় আক্রান্ত রোগী যদি গির্জায় না যেতেন, তাহলে সে দেশের করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা অর্ধেকে থেকে যেত। গত কয়েক মাসে সরকারি সিদ্ধান্তে অনেক অস্পষ্টতা লক্ষ করা গেছে। এবারও যদি এর পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে তার ফল ভয়ানক হবে। হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব মানা ও মাস্ক পরিধান—এসবের কোনো বিকল্প নেই। এটা হলো নতুন স্বাভাবিকতা বা নিউ নরমাল।

পরিশেষে যে বিষয়টির উল্লেখ করতে চাই তা হলো করোনাযুদ্ধে সর্বস্তরের অংশগ্রহণ, ‘এ হোল অব দ্য সোসাইটি অ্যাপ্রোচ’। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশের আপামর জনসাধারণ তথা রাজনীতিক, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, ছাত্র, শিক্ষক, সুশীল সমাজ—সবাই এক জোট হয়ে লড়েছিল। কিন্তু এই করোনাযুদ্ধে যেখানে এই সম্পৃক্ততার বেশি প্রয়োজন আমরা তা দেখছি না। মনে হচ্ছে এটা শুধু সরকারের একার মাথাব্যথা। আমার মনে হয় দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঝাঁকিয়ে পড়তে উদ্‌গ্রীব। প্রয়োজন শুধু সরকারের উদার মনোভাব আর কার্যকরী পদক্ষেপ। এই ব্যাপারে অচিরেই কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ১. সরকারের গঠিত করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটি যেমন জাতীয় কমিটি, সমন্বয় কমিটি, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলাওয়ারি কমিটিগুলোতে সরকারের বাইরের সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ২. প্রতিটি গ্রাম এবং শহরের পাড়ায় পাড়ায় সবার অংশগ্রহণে করোনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে, যার মাধ্যমে করোনা বিষয়ে জনগণকে সচেতন এবং বিভিন্ন নিয়ম কঠোর প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হবে। ৩. গ্রামাঞ্চলে যেসব স্বাস্থ্য সেবিকা বা কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাঁদের করোনার কাজে সংগঠিত করা। বর্তমানে সরকারি ও এনজিওদের দ্বারা প্রশিক্ষিত প্রায় এক লাখ সেবিকা আছেন, যাঁরা অতি সহজেই তিনটি কাজ সম্পন্ন করতে পারেন, যেমন সচেতনতা বৃদ্ধি, কন্ট্র্যাক্ট ট্রেসিং, করোনা উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ এবং তাঁদের নিকটস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রেরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন রুয়ান্ডায় স্বাস্থ্যসেবিকা ব্যবহার করে বিশেষ ফল পাওয়া গেছে। আমাদের দেশেও এসব কর্মী বাহিনী খাওয়ার স্যালাইন, প্রাথমিক পরিচর্যা, এমনকি যক্ষ্মা চিকিৎসায়ও বিশেষ অবদান রেখেছেন।

সবিশেষে বলব যে করোনা একটি দুষ্ট প্রকৃতির ভাইরাস। এর মতিগতির অনেক কিছুই এখনো আমাদের জানা নেই। তাই সমস্যা সমাধানে সবশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো তাই আমাদের দেশেও বৈজ্ঞানিক পরামর্শক গ্রুপ গঠন করা প্রয়োজন, যাঁরা সরকারকে বৈজ্ঞানিক কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন। এঁদের মধ্যে থাকবে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যেমন জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অর্থনীতি, উন্নয়ন গবেষণা ইত্যাদি।