আসন্ন বাজেট অর্থনীতির পাশাপাশি জীবন রক্ষার বাজেট

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। ফাইল ছবি
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। ফাইল ছবি

চলমান মহামারির ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় অর্থনীতি বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। সামগ্রিক জনজীবন যখন এই মহামারিতে প্রভাবিত, তখন অর্থনীতিকে সুনিপুণভাবে পরিচালনা করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মাধ্যমে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি চাহিদাভিত্তিক ও প্রয়োজনীয় খাতে গুরুত্বারোপ করে একটি বাজেট প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে বিভিন্ন সরকারি ব্যয় ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় নীতি গবেষণামূলক তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের আয়োজনে ‘ইয়ুথ মিটস লিডারস’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারে বক্তারা সম্প্রতি এই মতামত দিয়েছেন। ইয়ুথ পলিসি ফোরাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর জানিয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সেমিনারের শুরুতে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে সুপারিশমালা এবং কোভিড-১৯ সৃষ্ট বাস্তবতায় সরকারি নীতি সিদ্ধান্ত নিয়ে ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ) তাদের গবেষণালব্ধ মতামত ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে। সেমিনারটিতে মূল অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

ওয়াইপিএফের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ আখতার মাহমুদের সঞ্চালনায় আয়োজিত সেমিনারটিতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা-৯ আসনের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউড অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের পরিচালক মোহাম্মদ তারেক এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির।

সেমিনারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এবারের বাজেটকে গতানুগতিক ধরে নেওয়াটা খুবই ভুল হবে। তিনি কোভিড-১৯ সৃষ্ট অভিঘাত মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরোপের ওপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, বাজেট বাড়ছে, কারণ জনসংখ্যাও বাড়তির দিকে। কিন্তু এ বছর অনুৎপাদনশীল খাতগুলোতে ব্যয় সংকোচন করে, অত্যাবশ্যকীয় খাতগুলোতে বেশি গুরুত্বারোপ জরুরি। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পেনশন ও শিক্ষাবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টিকে সংস্কার করার পক্ষেও মতামত দেন তিনি।

সেমিনারে উপস্থিত সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বাজেটে পরিমাণগত আকার বাড়ার পাশাপাশি গুণগত তারতম্যও আসা উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালগুলো রয়েছে এবং আরও হাসপাতাল স্থাপনে উদ্যোগী বরাদ্দ যাচ্ছে। কিন্তু গুণগত মানোন্নয়নের ব্যাপারটিতে আমাদের গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।’ তাঁর মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়াটি অন্ততপক্ষে অনুসরণ করা উচিত। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানামুখী পদক্ষেপের ওপর জোর দেন তিনি।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, তামাক ও তামাকজাত পণ্যে কর বৃদ্ধি হলে, সরকারি কোষাগারে রাজস্ব বাড়বে, তামাকপণ্য ব্যবহারে সৃষ্ট মৃত্যুও কমবে, সেই সঙ্গে তামাক সেবনে সৃষ্ট রোগবালাইয়ে যে স্বাস্থ্যভিত্তিক বাড়তি খরচ, সেটিও কমানো সম্ভব হবে। তাঁর আশঙ্কা, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট নয়া পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদ–বৈষম্য আরও প্রকট হবে। এই ব্যাপারে নজর দিয়ে উচিত হবে করোনাভাইরাসের পরের অর্থনীতিকে জন-সমতাভিত্তিক করতে সচেষ্ট হওয়া।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির জানান, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যেভাবে হয়েছে, তাতে এই নতুন পরিস্থিতির বাজেট কতটুকু আশাব্যঞ্জক হবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তাঁর মতে, উদ্যোগী বাজেট হলেও সেটিতে বাড়তি অপচয় ও দুর্নীতির ঝুঁকি থাকবে। তবু শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতগুলোতে অধিকতর নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে পুরো আর্থিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা খাত ঢেলে সাজানোর পক্ষেও তিনি মত দেন।
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের পরিচালক মোহাম্মদ তারেক বলেন, দিন দিন চাষযোগ্য জমি কমতে শুরু করলেও, খাদ্যনিরাপত্তা টিকিয়ে রাখা গেছে কোনোভাবে। কিন্তু চাষযোগ্য জমির এই ক্রমহ্রাস রোধ করতে হবে। তা না হলে ফসলি জমির অভাবে রাষ্ট্র ক্রমশ সংকটে পড়বে।

বাজেটের মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করে মোহাম্মদ তারেক বলেন, বাজেটের বলা যায় পাঁচটি হাত। রাজস্ব আয়, ব্যয়, বাজেট ঘাটতি, ঘাটতি অর্থায়ন ও ঋণ। তাই সরকারের রাজস্ব খাতে সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া আরও জোরদার করার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, রাজস্ব খাতের ব্যাপারে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এর কাজ হবে রাজস্ব প্রক্রিয়া যুগোপযোগীকরণে তদারকি করা।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির বলেন, সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলায় উচিত দেশজ উৎপাদনমুখী অর্থনীতির ওপর আগামী দুই-তিন অর্থবছরে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া। এমনকি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ অবধি উত্তীর্ণ হলেও, জনগণের হাতে যাতে টাকা পৌঁছায়, সে লক্ষ্যে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সেমিনারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের বহু পুরোনো ঐতিহ্য। আমরা চেষ্টা করছি যথাসম্ভব দুর্নীতি রোধ করে সরকারি কর্মকাণ্ড চালাতে।’ ত্রাণ সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই দুর্নীতিগুলো হচ্ছে যখন তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণ বিলি-বণ্টন হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে এই ছোট ছোট দুর্নীতির ভাগগুলো কমিয়ে আনা যায়। এবং আমরা ইতিমধ্যেই সফল হয়েছি।’
ইয়ুথ পলিসি ফোরামের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ আখতার মাহমুদের এক প্রশ্নের উত্তরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সামাজিক বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ বহুলাংশে বৃদ্ধি হচ্ছে। গত ৩০ বছরের তুলনাও যদি করা হয়, এবারই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের হাতে টাকা প্রদান করতে সবচেয়ে বেশি সক্ষম হয়েছে সরকার।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ইয়ুথ পলিসি ফোরামের গবেষণা রিপোর্টে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বিচ্যুতি, সমন্বয়হীনতার অভিযোগ করা হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি বহুলাংশে একমত এবং এগুলো কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এম এ মান্নান বলেন, বাজেটসহ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে তরুণ সমাজের চিন্তা ও গবেষণামূলক অংশগ্রহণের সুযোগটি দেওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, ‘ইয়ুথ মিটস লিডারস’ শীর্ষক এই অনলাইন সেমিনারটি তাদের মাসব্যাপী ধারাবাহিক বাজেট সংলাপের চূড়ান্ত পর্ব ছিল। এর আগে বিভিন্ন পর্বে রাজনীতিবিদ, সরকারি নীতিনির্ধারণী ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে মাসব্যাপী বাজেট সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অনলাইন সেমিনারটির মূল আয়োজক ছিল ইয়ুথ পলিসি ফোরাম। আয়োজনটির নলেজ পার্টনার ছিল সিপিডি, বিআইজিএম ও লাইটক্যাসেল পার্টনার্স। আয়োজনটির মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার।