করোনাকালে চার খাত নিয়ে চার বিশেষজ্ঞের অভিমত

>

করোনাকালে ব্যাংক খাত ঝিমিয়ে পড়েছে, আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতারা কিন্তু বসে নেই। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা অভিবাসী শ্রমিকেরা গভীর সংকটে পড়েছেন। অতিমারির সময়ে মাঠ প্রশাসন বেশ সক্রিয়। তবে দুর্যোগকালেও আছে দুর্নীতির নানা অভিযোগ। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট চার খাতের চারজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন শরিফুজ্জামান

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা কিন্তু বসে নেই
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

দেশের ব্যাংক খাত আগেই সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা এত দিন ধামাচাপা পড়েছিল। এগুলো আবার সামনে চলে আসছে। ঋণখেলাপি, আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতাসহ এই খাতের দুষ্টচক্র চাচ্ছে করোনা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করতে।

করোনাকালে সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা মূলত ব্যাংকঋণনির্ভর। এতে ব্যাংকগুলো আরও বেশি সংকটে পড়বে। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়ার যে চেষ্টা চলছে, সেটি পুরোপুরি সম্ভব কি না, তা–ও দেখার বিষয়। কারণ, ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট রয়েছে। আবার এই প্রণোদনা যাঁরা পাওয়ার যোগ্য তাঁদের হাতে পৌঁছানোটা বড় চ্যালেঞ্জ।

কোনো ব্যাংক এখন পর্যন্ত সেভাবে বসে যায়নি, কিন্তু কয়েকটি ধ্বংসের দ্বারপ্রাপ্তে। বেসিক ব্যাংকের এত বড় কেলেঙ্কারি, কিন্তু সেই ব্যাংকের সরকার নিযুক্ত চেয়ারম্যানের কিছুই হয়নি, যিনি কিনা ব্যাংকের ৮০ শতাংশ টাকা লুট করে নিয়েছেন। ফারমার্স ব্যাংকের কর্ণধার সাবেক এক মন্ত্রী এবং তাঁর সমর্থনপুষ্ট চিশতি গং হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। তাঁরা তো বিচার–আচার আটকে রেখে জেল থেকে বেরিয়ে আসার আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। আর ফারমার্স ব্যাংকটি নাম বদলে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) জিম্মি করে ফেলছেন। দুদক বেশ কিছু ভালো কাজ করলেও আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতাদের কাছে গিয়ে কখনো কখনো আটকে যাচ্ছে, সরকারের ভেতর থেকেও কেউ কেউ নানাভাবে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ছাড়াও হলমার্ক, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, ডেসটিনি, তারও আগে যুবক এবং ছোট–বড় আরও বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক খাতকে নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।

ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা থেমে নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হত্যার হুমকির ঘটনা এই খাতকে নাড়া দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ঋণ না দেওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংকের দুই পরিচালক তাঁদের নির্যাতন করেছেন। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, আবার মামলার আসামিরা করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিদেশে চলে গেছেন বিশেষ ব্যবস্থায়।

এ ধরনের ঘটনায় মানুষ হতাশ হয়, তারা কঠোর ব্যবস্থা দেখতে চায়। এর ফলে অন্যরাও এমন কাজ না করার বার্তা পাবে।

এটা খেয়াল করা দরকার, সাধারণ মানুষ যেন মনে না করে ব্যাংক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারিতে সরকারের উঁচু পর্যায়ের লোকজন জড়িত আছে। তাহলে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যাবে। করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতারা কোনোভাবেই যেন ছাড় না পায়।

সুদের হার ৯ ও ৬ শতাংশ করায় ব্যাংকগুলোর আয় কমবে। এক পরিবারে দুজনের বদলে চারজনকে পরিচালক করা, ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর পরিচালক হিসেবে থাকা—এসব সিদ্ধান্ত ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সংকট আরও ঘনীভূত করবে।

এই মুহূর্তে দরকার একটি ব্যাংকিং কমিশন বা উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে ব্যাংকগুলো কীভাবে উদ্ধার পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা।

আলী ইমাম মজুমদার।
আলী ইমাম মজুমদার।

সাপ্তাহিক ছুটি এখন এক দিন করা উচিত
আলী ইমাম মজুমদার

প্রত্যাশার চেয়ে প্রশাসন এই সংকটে ভালো কাজ করেছে। প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে অনেক খুশি। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভালো কাজ করছেন।

করোনাকালের শুরু থেকে প্রায় সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করছেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এটা করতে গিয়ে তাঁদের অনেকে আক্রান্ত, কয়েকজন কর্মকর্তা মারা গেছেন।

মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। দায়িত্ব ছাড়াও মানবিক কারণে তাঁরা কাজ করছেন। এই সময়ে তাঁদের শুক্র, শনি বা দিনরাত নেই। এসব কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই।

সব পেশার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই পরিস্থিতিতে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশাসনের দায়িত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বেশি। ঢাকার বাইরে একজন করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক কোথায় থাকবেন, তাঁর জন্য হোটেল ঠিক করা বা বাড়ি ভাড়া করে দেওয়ার কাজটিও অনেক সময় প্রশাসন করছে। দাফনের দায়িত্ব নিচ্ছে, বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। কথাগুলো এ জন্য বললাম যে ছকবাঁধা দায়িত্বের বাইরেও সরকারি কর্মকর্তাকে অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে একটি বড় কাজ হচ্ছে ত্রাণ বিতরণ করা। কাজটি ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের, কিন্তু করতে হয় মাঠ প্রশাসনকে। কাজটি খুবই জটিল ও দুরূহ। সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না। আবার স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এখান থেকে কিছু পকেটে নিতে চান, দলের লোক বা সমর্থককে প্রাধান্য দিতে চান। এটা নতুন বিষয় নয়। কিন্তু আমি বলব, এবারের পরিস্থিতি অনেকটা সহনশীল। ভুলভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি বেশ কম। যেসব জনপ্রতিনিধি উল্টাপাল্টা করতে চেয়েছেন, সরকার কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে। যদিও আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

করোনাকালে মাঠ প্রশাসন ভালো করলেও কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খুব বেশি সমালোচিত হয়েছে। চিকিৎসকদের মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে একদিকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, অন্যদিকে সেগুলো ছিল নিম্নমানের। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কে নানা অভিযোগ শোনা গেল, যেটা এই পরিস্থিতিতে কাম্য ছিল না। আবার সচিবকে সরিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু মন্ত্রী রয়ে গেলেন। দায় যদি থাকে, তাহলে তা কিন্তু দুজনেরই। আসলে তাঁদের দায়িত্ব ছিল এই অতিমারিতে সবাইকে নিয়ে কাজ করা, যেটি তাঁরা ভালোভাবে করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

প্রশাসনে ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তন আসছে, আরও আসবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যত বেশি বাড়বে, স্বচ্ছতা তত বেশি নিশ্চিত হবে। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের পুরস্কার পেয়েছে। পার্বত্য তিন জেলা বাদে জমির নামজারির কাজ এখন অনলাইনে হচ্ছে, এটা সাধারণ মানুষের জন্য বড় পাওয়া। তবে হ্যাঁ, প্রযুক্তির পেছনে তো মানুষ থাকে, দুরভিসন্ধি থাকবে এবং তা ঠেকানোর চেষ্টাও করে যেতে হবে।

সচিবালয় বা সরকারের বিভিন্ন কার্যালয় ধীরে ধীরে খুলছে। আস্তে আস্তে কাজের গতি বাড়বে। কিন্তু কর্মকর্তাদের বড় দায়িত্ব অন্যদের সচেতন করা। প্রত্যেক কর্মকর্তা নিজের অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষকে এই পরিস্থিতিতে সচেতন করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। মাস্ক পরুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন—এসব কথা বারবার বলতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন সরকারি কর্মকর্তার কথা মানুষ কিন্তু আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে।

করোনাকালে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য প্রকল্প পিছিয়ে গেছে। কাজের স্তূপ জমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে আমার আবেদন, সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন করা হোক। এখন সপ্তাহে আর দুই দিন ছুটি থাকার প্রয়োজন নেই, অন্তত একটি বছর। আর অনেকেই তো ছুটি কাটাতে কাটাতে বিরক্ত হয়ে গেছেন।

তাসনীম সিদ্দিকী।
তাসনীম সিদ্দিকী।

দেশে-বিদেশে সংকটে অভিবাসী শ্রমিকেরা
তাসনীম সিদ্দিকী

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৩০ সালে বলেছিল, বিশ্বে বড় ধরনের সংকটে অভিবাসী শ্রমিকেরাই তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। করোনাকালে আমরা দেখলাম, আসলে অভিবাসী শ্রমিকেরা কতটা অনিরাপদ ও অরক্ষিত। একমাত্র সিঙ্গাপুর ছাড়া কোথাও অভিবাসী শ্রমিকেরা সুরক্ষা পাননি। সর্বত্রই কষ্টে আছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা, তাঁদের একদিকে খাদ্যাভাব, অন্যদিকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আবার যাঁরা করোনার আগে দেশে এসেছেন, তাঁদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ আপাতত নেই।

আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী, অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব ওই দেশের, ২০১৬ সালে এমন একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন সুরক্ষা দেওয়া দূরে থাক, উল্টো ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতিতে অভিবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরি হচ্ছে, তাঁদের মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না, দিলেও তা খুবই কম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব ঘটনা বেশি ঘটছে।

অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁরা ভীষণ সমস্যায় পড়েছেন। তাঁদের পরিবারও সংকটে পড়েছে। সরকারের খাদ্য ও নগদ কর্মসূচির আওতায় তাঁদের নেওয়া উচিত ছিল।

অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ৫০০ কোটি টাকা এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। কিন্তু পরিমাণে এটা খুবই কম। যদি গার্মেন্টসে ৫ হাজার কোট টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে এঁদের জন্য এত কম হবে কেন? তা ছাড়া গার্মেন্টস ২ শতাংশ সুদ, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য তা ৪ শতাংশ হবে কেন? আমার তো মনে হয়, প্রবাসী শ্রমিকদের গলার জোর কম।

এই ঋণ কাজে লাগানোটাও বড় চ্যালেঞ্জ। আন্তমন্ত্রণালয়ভিত্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। তা না হলে কেবল ঋণ দিয়ে ছেড়ে দিলে দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় তাঁদের অনেকেই কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরিসহ তাঁদের বঞ্চনার বিষয়গুলো জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরতে। দেশি-বিদেশি অভিবাসী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সেই চেষ্টা করছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদালত যেন করা হয়, যাতে ওই আদালতের কাছে অভিবাসী শ্রমিকেরা তাঁদের বঞ্চনার কথা জানাতে পারেন এবং প্রতিকার পান।

আমাদের প্রবাসী আয় এবার কম হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে ২২ শতাংশ কমবে। রেমিট্যান্স স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটি হতে পারে, বৈধভাবে টাকা পাঠালে প্রণোদনা ২ শতাংশের বদলে ৪ শতাংশ করা। সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচিগুলো এবং জাতীয় বাজেটে অভিবাসী ও অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের কথা ভাবতে হবে। সবশেষে আমার আবেদন, অভিবাসী শ্রমিকদের সম্পর্কে আমাদের অনেকের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তাঁদের হেয় করবেন না।

করোনাকালে অবৈধ উপায়ে শ্রমিক পাচার কিন্তু বেড়ে যাবে, সেই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপে যাওয়ার সময় ৭০০ বাংলাদেশি উদ্ধার হয়েছে। করোনা–উত্তর সময়ে এটা বাড়বেই। এ জন্য মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আরও বেশি কঠোরতা প্রয়োজন।

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কিন্তু এখন বড় দায়িত্ব পালন করার সুযোগ আছে। কোনো কোনো এজেন্সির মালিক এই খাত থেকে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন, কেউবা জনপ্রতিনিধি, কেউ কেউ ব্যাংক-বিমা, হোটেল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাঁদের উচিত অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কিছু করা, এতে তাঁদের যে বদনাম বা ভাবমূর্তি সংকট আছে, তা অনেকটাই ঘুচতে পারে। তাঁরা বায়রার মাধ্যমে এটা করতে পারেন, বায়রাও তাঁদের নিয়ে এই মানবিক উদ্যোগ নিতে পারে।

ইফতেখারুজ্জামান।
ইফতেখারুজ্জামান।

দুর্নীতির মনোভাবটা কিন্তু রয়েই গেছে
ইফতেখারুজ্জামান

বিশ্বজুড়ে একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, বড় দুর্যোগের সময় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। এই পরিস্থিতিকে কেউ কেউ কাজে লাগায়। আবার সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করার প্রস্তুতি ও চেষ্টা থাকে।

নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা শুরু থেকেই আশঙ্কা করছিলাম, এই বিপুল কর্মযজ্ঞে অনিয়ম-দুর্নীতি হবে। তবে আমাদের আশাবাদও ছিল, মানবিক এই বিপর্যয়কালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা নেতিবাচক কিছু করবেন না।

কিন্তু দেখা গেল, আমাদের সেই আশা যথার্থ ছিল না। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি, তার প্রমাণ আবারও পাওয়া গেল। দুর্যোগকেন্দ্রিক দুর্নীতি হয়েছে, হচ্ছে। তবে অনেকে চেষ্টা করেও নানা কারণে পারছে না। অর্থাৎ দুর্নীতির মনোভাবটা কিন্তু রয়েই গেছে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় কিন্তু বিষয়টা জানত। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একাধিকবার বলেছেন, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। তাঁর সুষ্পষ্ট অবস্থানের পরও কিন্তু দুর্নীতি হয়েছে। গণমাধ্যমে সব না হলেও কিছু কিছু খবর আসছে। স্বাভাবিক সময় হলে এমন আরও অসংখ্য খবর আমরা হয়তো পেতাম। কিন্তু এর মধ্যেও যেটুকু আমরা পাচ্ছি, তা–ও কম না। অন্তত এত বড় দুর্যোগের মধ্যেও এত কিছু হওয়াটা কাম্য নয়।

মাঠপর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, আবার কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু করতে পারেনি। মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে কত কিছু হলো। কিন্তু আমরা কি নির্দিষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে পারলাম, কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত? পারস্পরিক দোষারোপ, অভিযোগ, গণমাধ্যমে প্রতিবেদন, তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদন, বদলি—এসবের মধ্যে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ল। এই দুর্নীতি কে করেছে, তার শাস্তি চাই, তাকে চিনতে চাই, তার চাকরিচ্যুতি চাই এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চাই। তা না হলে এ ধরনের ঘটনার প্রতিকার হবে না।

এই অতিমারির সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনেক কেনাকাটা হচ্ছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। স্বাস্থ্যের দুর্নীতি তো অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এখানে কেনাকাটায় ঠিকাদার-কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট থাকে। ভালো ও সৎ কর্মকর্তা টিকতে পারেন না। এখনকার কেনাকাটা নিয়ে এখনো কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী, যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন সিলিন্ডার—অনেক কিছু কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, গণমাধ্যমে প্রতিবেদন দেখছি।

আমরা প্রতিটি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা চাই, জবাবদিহি চাই। কেউ দুর্নীতি, অনিয়ম করলে শাস্তি চাই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করাই কি যথেষ্ট? তাঁদের রাজনৈতিক দল থেকে চিরকালের জন্য বহিষ্কার করুন, বাকি জীবনে কোনো নির্বাচনে যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করুন। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করুন। এতে কেউ নাখোশ হবে না, বরং খুশি হবে। দল ও সরকারের মানহানি করায় সংশ্লিষ্ট নেতার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুন। কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের নির্দেশ মানেননি।

একইভাবে মাস্ক, পিপিই কেনাসহ স্বাস্থ্যের সব কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। এই মহাদুর্যোগের সময় যারা দুর্নীতি করে সম্পদ বাড়াতে চায়, তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করুন। করোনাকালে আমরা আবারও প্রমাণ পেলাম, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারিনি। তবে আমাদের সবাইকে সেই চেষ্টা করে যেতে হবে।

বিশেষ উদ্বেগের বিষয় এই যে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারার অপব্যবহার করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ঘাটতির সমালোচনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাংশের বেশি তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান,  আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তাসনীম সিদ্দিকী: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু), ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।