হাসপাতালে শয্যা ও আইসিইউ সংখ্যায় গরমিল

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আইসিইউ ইউনিট।  প্রথম আলো ফাইল ছবি
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আইসিইউ ইউনিট। প্রথম আলো ফাইল ছবি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) যে সংখ্যা দিচ্ছে, বাস্তবে রয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। গোঁজামিল দিয়ে শয্যা ও আইসিইউর সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে।

গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা রয়েছে ১৩ হাজার ৯৮৪টি। এর মধ্যে রাজধানীতে ৭ হাজার ২৫০টি।

অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর নাম, শয্যা, আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস শয্যার তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখনো প্রস্তুত না হওয়া হাসপাতালের নাম ও শয্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনের তালিকায় যোগ করা হয়েছে। বাস্তবে শয্যা আছে ৫ হাজারেরও কম। বলা হচ্ছে, আইসিইউ রয়েছে ২১৮টি। এর মধ্যে চালু হয়নি এমন আইসিইউর সংখ্যাও যুক্ত করা হয়েছে। আদতে আইসিইউ রয়েছে ১৪০টিরও কম। আবার এসব আইসিইউর সব কটি সচল নেই।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে শয্যার বিষয়টি অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) বলতে পারবেন।’ পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, তালিকাটি অবশ্যই হালনাগাদ করা উচিত। প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে বলে দুটি হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা তালিকায় দেখানো হয়েছে। আর যে হাসপাতাল চিকিৎসা কার্যক্রম থেকে সরে গেছে তাকে এই তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেও অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এখনো করোনা চিকিৎসা শুরু হয়নি। ফলে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতেই রোগীদের যেতে হচ্ছে।

প্রস্তুত না হওয়া হাসপাতাল ও শয্যা তালিকায়

মহাখালীতে অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে একটি আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণের কাজ চলছে। এখানে থাকবে ১ হাজার ৫০০ শয্যা। যদিও তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।

করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আড়াই শ শয্যার একটি ফ্রন্টলাইনার্স হাসপাতাল করছে অধিদপ্তর। এই হাসপাতালে ৫০টি আইসিইউ এবং ৪টি ডায়ালাইসিস সুবিধা থাকবে। এখনো প্রস্তুত না হওয়া এই হাসপাতালে শয্যা, আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস শয্যাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হিসাবে দেখাচ্ছে। এই প্রস্তুত না হওয়া হাসপাতালগুলোর শয্যা বাদ দিলে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৫ হাজার।

সরে যাওয়া হাসপাতালও তালিকায়

গত ১৬ মে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল হিসেবে কাজ শুরু করে আনোয়ার খান মডার্ন কলেজ হাসপাতাল। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বিনা মূল্যে করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছিল হাসপাতালটি। ১ জুন থেকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে গেছে হাসপাতালটি।

হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক এহতেশামুল হক গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ১ জুন থেকে সরকারের সঙ্গে করা সমঝোতা থেকে সরে এসেছে আনোয়ার খান মডার্ন কলেজ হাসপাতাল। তবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে করোনা রোগীদের নন-কোভিড রোগীদের মতোই চিকিৎসা খরচ দিতে হবে।

অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় গত শনিবারও আনোয়ার খান মডার্ন কলেজ হাসপাতালের ২০০ শয্যা ও ১০টি আইসিইউকে করোনার জন্য নির্ধারিত হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই ২০০ শয্যা বাদ দিলে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা থাকে ৫ হাজার ৩০০টি।

কমে যাওয়া শয্যাগুলো বাদ দেওয়া হয়নি

স্বাভাবিক হাসপাতালের শয্যার সঙ্গে করোনা রোগীদের চিকিৎসার শয্যায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। সংক্রমণের কারণে করোনা রোগীদের একেকটি শয্যার মধ্যবর্তী দূরত্ব বা স্পেস বেশি রাখতে হয়। ফলে হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত শয্যার চেয়ে করোনার শয্যাসংখ্যা কিছুটা কম হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় করোনার জন্য নির্ধারিত মুগদা হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার। হাসপাতালের সদ্য সাবেক পরিচালক অধ্যাপক গোলাম নবী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনার চিকিৎসার দুই শয্যার মধ্যে দূরত্ব বেশি রাখতে হয়। দূরত্ব রেখে শয্যা সাজানোর পর মুগদা হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৩৫০টি শয্যা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, মহানগর জেনারেল হাসপাতালে করোনার জন্য ১৫০টি শয্যা রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে সর্বোচ্চ ১০০ জনের সেবা দেওয়া সম্ভব। মিরপুরের মাতৃ ও শিশু হাসপাতালটি ২০০ শয্যা দেখানো হলেও সেখানে করোনার শয্যা রয়েছে ১৩০টি। মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালটিতে ২৫০ শয্যা দেখানো হলেও হাসপাতালটিতে শয্যা রয়েছে ১৪০টি।

রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি সাতটি হাসপাতালে মধ্যে পাঁচটিতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকার চেয়ে ৪১১টি শয্যা কম রয়েছে। এই শয্যাগুলো বাদ দিলে করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যা থাকে ৪ হাজার ৮৮৯টি।

আইসিইউর হিসাবেও গরমিল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য ৩৯৯টি আইসিইউ রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ২১৮টি আইইসিইউ। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতালে এখন সেবা দেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ১৪০টিরও কম। এর মধ্যে সব আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না।

প্রস্তুত না হওয়া ফ্রন্টলাইনার্স হাসপাতালের ৫০টি আইসিইউ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তালিকায় যুক্ত করেছে। মহানগর হাসপাতাল এবং মাতৃ ও শিশু হাসপাতালে মাসখানেক আগে ৫ শয্যার আইসিইউ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। দুই সপ্তাহ আগে চালুর কথা থাকলেও গত শনিবার পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা চালু হয়নি। কিন্তু এই ১০টি আইসিইউকে তালিকায় দেখানো হয়েছে।

মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালটিতে ১৬টি আইসিইউ রয়েছে বলা হলেও বাস্তবে রয়েছে ১৪টি। মার্চের শুরুতে হাসপাতালটিকে করোনার জন্য নির্ধারণ করা হলেও গত শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালটিতে করোনা রোগী ভর্তি করা হয়নি। হাসপাতালের পরিচালক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে ১৪টি। আর ডায়ালাইসিস শয্যা দুটি। রোগী ভর্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

হাসপাতালে যে পরিমাণ আইসিইউ রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, সেগুলোর সব কটি রোগী ভর্তির অবস্থায় নেই। কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ২৬টি আইসিইউ রয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেহাব উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, অবেদনবিদ (অ্যানেসথেটিস্ট) না থাকা ও আনুষঙ্গিক কিছু কারণে সব আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পেলেও সরকার প্রস্তুতিই শেষ করতে পারেনি। যেসব শয্যা ও আইসিইউ নেই, সেগুলো কেন বলা হবে? এর মাধ্যমে দেশবাসীকে চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা দেওয়া হচ্ছে। ছলচাতুরী না করে যা আছে, তাই বলা উচিত।’