হুইলচেয়ারে নাহিয়ানের এগিয়ে চলা

নূর নাহিয়ান
নূর নাহিয়ান

ক্রিকেট মাঠ সব সময় টানত নূর নাহিয়ানকে। কিন্তু কে জানত ক্রিকেট খেলতে গিয়েই নাহিয়ানের জীবনে নেমে আসবে এমন অমানিশা! সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিলেন নাহিয়ান। ক্যাচ ধরতে গিয়ে অসতর্কতার সঙ্গে ডাইভ দেন। এরপর মেরুদণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধে। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ হতে পারেননি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া নাহিয়ানের এখন চলাফেরার একমাত্র অবলম্বন হুইলচেয়ার।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে ভীষণ মুষড়ে পড়েন নাহিয়ান। কিন্তু যে খেলার জন্যই জীবনে বড় দুর্ঘটনা নেমে এসেছিল, সেই খেলার মধ্যেই এখন সব আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করেন বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া এই তরুণ। বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের নিয়মিত মুখ নাহিয়ান। গত বছর মে মাসে নেপালে চার জাতি এশিয়া কাপ হুইলচেয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলেছেন। গত বছর অক্টোবরে জাপানের নাগোয়াতে আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার ম্যারাথনে অংশ নেন। খেলেছেন জাতীয় প্যারা ব্যাডমিন্টন ও হুইলচেয়ার টেবিল টেনিস। নিজে প্রতিবন্ধী বলেই কিনা করোনা–ভাইরাসের এই দুঃসময়ে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কেঁদে ওঠে নাহিয়ানের মন। শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা খুলেছেন। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাহিয়ান। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবন্ধী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে এই প্রতিষ্ঠান। তহবিল গড়ে অর্থ ও খাবার দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার ৩৯৪ জন প্রতিবন্ধী মানুষকে সাহায্য করেছে।

নিজে হুইলচেয়ারে চলাচল করে অসহায়দের সহযোগিতা করতে পেরে খুব খুশি নাহিয়ান। বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ৬৪টি জেলায় ত্রাণ দেওয়ার। কিন্তু আমরা মাত্র ১৪টি জেলায় সহযোগিতা করতে পেরেছি। কোথাও বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাই। কোথাও খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছি। রংপুরে ঈদের আগে ঈদ উপহার দিয়েছি। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পেরে ভালো লাগছে।’ শুধু প্রতিবন্ধী নয়, সুস্থ–স্বাভাবিক ৫৬ জন হতদরিদ্র মানুষকেও সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন।

নাহিয়ানের দেওয়া সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।  ছবি: সংগৃহীত
নাহিয়ানের দেওয়া সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ফাউন্ডেশনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ নাহিয়ানের। শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে সহযোগিতার আবেদন করেন। এঁদের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই মূলত ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন নাহিয়ান। তাঁর কথায়, ‘আসলে আমাদের এই কাজের বড় সমস্যা হয়েছে তহবিল জোগাড় করা। চেনাজানা মানুষদের কাছ থেকেই টাকাপয়সা নিচ্ছি। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও অটিজম ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করেছে কিছু।’ সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলের সাবেক ছাত্রদের সংগঠনও তাদের ফাউন্ডেশনের জন্য সহযোগিতা করেছে।

দুঃসময়ে কখনোই ভেঙে পড়েননি নাহিয়ান। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোই ভাগ করতে চান করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের কাছে, ‘তখন মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। একবার নানাবাড়িতে গিয়ে মামাতো ভাইদের বলি, হুইলচেয়ারে বসেই ক্রিকেট খেলব। ওরা আমার কথা শুনে অবাক হয়েছিল। কিন্তু ঠিকই আবারও খেলার মাঠে ফিরে এসেছি। জানি, এই দুঃসময় শেষ হয়ে একদিন আলো আসবেই। দুস্থ মানুষদের সহযোগিতা করার সময়ও একটা কথাই বলি, ভেঙে পোড়ো না। হয়তো অচিরেই কেটে যাবে এই অন্ধকার সময়।’