ভীতি থেকে অবসাদ, অতঃপর বিশ্রান্তি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

কোয়ারেন্টিন! শব্দটার সঙ্গে আমরা বাঙালিরা নতুন বছরে নতুন কিছু শেখার মতো করে জানতে পেরেছি। যদিও–বা কেউ কেউ জানত! তবে ব্যবহারটা বোধকরি সেই ভাবে হয়ে ওঠেনি এই যাহ। এ আর এমনকি, আমরা মেয়েরা তো এই কোয়ারেন্টিন-লকডাউনের সঙ্গে অতিপরিচিত দৈনন্দিন জীবনে। আর মায়েরা তো সারা জীবনই থাকেন লকডাউনে। সারা দিন বাসায়, রান্না-খাওয়া-রান্না-খাওয়া-ঘুম, আবার রান্না-খাওয়া-ঘুম। চক্রাকারে চলতে থাকে রোজ।

আমার প্রাণের শহর খুলনাতে গত এক সপ্তাহে করোনাভাইরাস এইভাবে হানা দেবে আগে বুঝিনি। একে একে শুনি শুধু আক্রান্তের সংবাদ। দেখতে দেখতে আমার ভবনটাও লকডাউন হয়ে গেল। ঈদে শপিং মলগুলো খুলে দেওয়া, মাস্কহীনভাবে মানুষের অবাধে বাইরে বের হওয়া, যেখানে–সেখানে আড্ডায় মেতে থাকা, ডাক্তারদের কাছে তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেওয়া এবং করোনায় আক্রান্ত রোগী নির্দ্বিধায় বাইরে ঘুরাঘুরির ফল ভোগ করছে আজ খুলনাবাসী। ঈদে শপিং করা মানুষের কাছে একটাই প্রশ্ন, জীবনের থেকে কি শপিং জরুরি ছিল? আমার খুলনার মানুষ এখনো কেয়ারলেস। পুলিশ দোকান বন্ধ করতে বললে হেসে উড়িয়ে দেয়।

যাহোক, করোনাকালে সবার জীবনে নানাভাবে পরিবর্তন এসেছে। আমার জীবনের পরিবর্তনের মোড়গুলো তুলে ধরলাম কিছুটা।

১.
জীবনের প্রথম ঈদ করলাম আমার আব্বা-মাকে ছাড়া। ঈদে বাড়ি যেতে পারলাম না। আর বিয়ের পর প্রথম ঈদ করলাম স্বামীকে ছাড়া। ও থাকে চট্টগ্রাম, ঈদের আগে রোজা থেকেই চট্টগ্রাম ছিল করোনার হটস্পট। ও আর আসতে পারল না। আসলে ঈদ তো আমরা করিনি! কিচ্ছুটি কিনিনি। না নতুন কাপড়, না ঈদের সদাইপাতি, না মেহমান, না নামাজ, নাহ, কিছুই করিনি তো আমরা। আমরা বাঁচতে চেয়েছি আগে। তবে সেটা শুধু নিজের জন্য নয়, আমার পরিবার, আমার প্রত্যেকটি আপনজন, প্রত্যেকটি প্রিয় মানুষের জন্য বাঁচতে চেয়েছি। এখনো চাই বাঁচতে, যেন পরবর্তী দিনগুলো, বাকি ঈদগুলো সবাই একসঙ্গে করতে পারি।

২.
ইউনিভার্সিটিকে বিদায় জানিয়েছি চার বছর হতে চলল। গত দুই বছর সংসারের ‘স’টাও করিনি চাকরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে। পরীক্ষা শেষে এখন সংসার করার একটা মোক্ষম সময় পেয়েছিলাম। আর সে জন্য ছুটে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে, আমার অর্ধাঙ্গের কাছে। করোনা আর সংসার করতে দিল কই! পাক্কা এক সপ্তাহের মাথায় খুলনার পথ ধরতে হলো লকডাউন আর সেলফ কোয়ারেন্টিনের তাড়নায়। চলে এলাম আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে। তাঁরা বৃদ্ধ, যেহেতু বয়স্কদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, সেহেতু আমি আর তাঁদের নিয়ে ঝুঁকি নিলাম না। হয়ে গেলাম বাড়ির ছেলে। বাইরের সব কাজ আমি করা শুরু করলাম। দুই মাস হলো তাঁদের বাসা থেকে এক পা–ও বের হতে দিইনি। সব রকম প্রোটেকশন নিয়ে আমি নিজে গিয়েছি সবখানে। অনলাইনে সবজি, মাছ, মাংস, দুধ কিনেছি। মাছ না খেতে খেতে এমন হয়েছে যে হঠাৎ একদিন মাছ খেতে গিয়ে খেতে পারছি না। শাকসবজিই অনেক প্রিয় হয়ে গেছে আমার।

৩.
বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই, চাকরিটা বোধ হয় আর পাওয়া হলো না! যেটুকু আশা ছিল, কোভিড-১৯ এসে সেটাও ভেঙে দিয়েছে। লকডাউনে চাকরিজীবী এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কী করছিস?’। উত্তরে বলেছিল, ‘তুই এত দিন যা করেছিস তা–ই করছি! অফিস বন্ধ, বেকার ঘরে বসে আছি।’ এই কথা শুনে বুঝলাম, করোনা আসুক আর ভূমিকম্প আসুক, কিছু মানুষ তিতো কথা শোনানোর সুযোগ কখনোই ছাড়ে না। আর চারপাশে তো দেখছিই মানুষ কতটা অমানবিক! মানবিক-অমানবিক সমাজে আগেও বিরাজমান ছিল, করোনা শুধু চোখে আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিল আমাদের।

৪.
করোনাকালে বুক ভরে তাজা অক্সিজেন নিতে পারছি, এটাই যেন বড় প্রাপ্তি রোজকার দিনে। কোকিলের ডাক শোনা তো দূরের কথা, কোকিল পাখির দেখা মেলাই ভার ছিল এই শহরে। আর আজ টানা এক মাস কোকিল পাখির দেখা মেলে আমার বেলকনির সামনের গাছে। একজোড়া কোকিল বাসা বেঁধেছে নারকেলগাছে। সন্ধ্যা হলেই তাদের গান শুরু হয়। আর এখন রোজ ঘুম ভাঙে দোয়েল আর চড়ুই পাখির গানে। এই প্রকৃতি দেখব বলে কোনো দিন ভেবে ছিলাম কি! রোজ বিকেলে প্রতিটি ছাদে ঘুড়ি উড়ায়। কেউবা নরমাল ঘুড়ি, কেউবা বাজপাখি আবার কেউবা অক্টোপাস ঘুড়ি বানিয়ে রঙিন আকাশে ওড়ায়। একেকটা ঘুড়ি যেন একেকটা স্বপ্ন, শুধু আকাশ ছুঁতে চায়।

সব কথার শেষ কথা, এখনো সুস্থ আছি, ভালো আছি। বুয়া নেই! দিব্বি সব কাজ করছি! একটা বুয়া যে একটা বাসাকে ঘর বানিয়ে রাখত, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এত কাজ একজন মানুষ করত কীভাবে! করোনা অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত শেখাচ্ছে। আমরা আর একটু সচেতন হলে করোনা থেকে মুক্তি পেতে পারি। কি পারি তো, তা–ই না! নিজে সচেতন হই, নিজে বাঁচি, প্রিয়জনদের বাঁচাই। সর্বোপরি দেশকে বাঁচাই, সারা বিশ্বকে বাঁচাই।