ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও আমাদের করণীয়

>আজ ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনার চুম্বক অংশ প্রকাশ হলো। বিস্তারিত আলোচনাটি আজ বেলা ২টা ৩০ মিনিটে প্রথম আলো অনলাইন এবং প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হবে।


মোহাম্মদ আবু সাদেক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ
১৮৯৭ সালের ১২ জুন। ইতিহাসের ভয়াবহতম ভূমিকম্প আঘাত হানে বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে। এর উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার ছিল বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি তৎকালীন আসাম ও বর্তমানের মেঘালয়। উপকেন্দ্র থেকে কেন্দ্রের গভীরতা ছিল ৩২ কিলোমিটার। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। সর্বোচ্চ তীব্রতা ছিল ১০। সীমাহীন সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিসহ মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৪২।

অনেক এলাকার বাড়িঘর, নারকেল ও সুপারিবাগান মাটির নিচে চাপা পড়ে। ব্যাপকভাবে রাস্তা, পুল ও রেললাইন ধ্বংস হয়। মাটিকে পানির মতো ঢেউ খেলতে দেখা যায়। ময়মনসিংহ এলাকার প্রচুর একতলা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব ইটের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূতাত্ত্বিক ও ভূমির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প ও ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎসস্থল (এপিসেন্টার) ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও চারপাশে বেশ কিছু সিসমিক গ্যাপ আছে। একে ভূমিকম্পের উৎসস্থল বলা হয়। ভূতত্ত্ববিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশে যেকোনো সময় মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারব।


ড. রাকিব হাসান: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
১৮৯৭ সালে যে মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা যদি বর্তমানে আসামে আবার হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশ বহুগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মূল কারণ হচ্ছে, আমাদের ভবনের সংখ্যা বেড়েছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে চলা। কিন্তু কেবল বিল্ডিং কোড থাকলেই হবে না, প্রয়োজন এর সফল ও সঠিক প্রয়োগ।

২০০৬ সালের বিল্ডিং কোডের সঠিক প্রয়োগ দেশে হয়নি। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য তেমন কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। প্রতিবার বিল্ডিং কোডের নতুন সংস্করণ বের করতে অনেক সময় চলে যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, প্রতিবারই একটি নতুন প্রকল্প হিসেবে নিয়ে প্রকল্পের আওতায় বিল্ডিং কোডের নতুন সংস্করণ তৈরির ব্যাপারটি দেখা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির আওতায় যদি নতুন সংস্করণ প্রকাশের বিষয়টি দেখা হয়, তাহলে নিয়মিতভাবে বিল্ডিং কোড প্রকাশিত হতে পারবে।


ড. খান মাহমুদ আমানত: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
একটা কংক্রিট ভবনে যে মৌলিক উপাদানগুলো দরকার, সেগুলো হচ্ছে সিমেন্ট, স্টোন চিপস বা খোয়া, বালু, পানি এবং এমএস রড। এর মধ্যে একমাত্র এমএস রডের গুণাগুণ বিবেচনা করে একটা ভবনের ভূমিকম্পসহনীয়তা নির্ধারণ করা হয়। রড টেস্ট করার পর এর যে ব্রেকিং স্ট্রেন্থ ও ইল্ড স্ট্রেন্থ হবে, এই দুয়ের অনুপাত ১ দশমিক ২৫ বা তার থেকে বেশি হতে হবে। রড টেস্ট করার পর এর প্রসারণের মান হবে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৪ শতাংশ। এসব গুণ যে রডে থাকবে, সেই রড দিয়ে ভূমিকম্পসহনীয় কংক্রিট ভবন তৈরি করা যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের রোড আমাদের দেশের বাজারে পাওয়া যাবে কি না। হ্যাঁ, আমাদের দেশে ভালো কোম্পানিগুলো যে রড তৈরি করে, তাদের তৈরি ৬০ গ্রেড রডে এসব গুণ সাধারণত পাওয়া যায়। সবশেষে বলতে চাই যে একটা নিরাপদ আধুনিক টেকসই এবং দীর্ঘকাল ব্যবহারযোগ্য ভবন নির্মাণের জন্য বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) ২০২০ একটা সম্পূর্ণ প্যাকেজ। এর দ্রুত প্রকাশনার জন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


ড. মো. তারেক উদ্দিন: অধ্যাপক, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি
ব্যবহারের দিক থেকে যদি দেখি, তাহলে পানির পরেই কংক্রিটের অবস্থান। নির্মাণ খাতে ব্যাপকভাবে কংক্রিটের ব্যবহার হচ্ছে। এটাই বড় প্রশ্ন যে এই বস্তুকে কীভাবে ভূমিকম্পসহনীয় করতে পারি। প্লেন কংক্রিট ভূমিকম্পসহনীয় হবে না। কংক্রিটের স্ট্রেন্থ বাড়াতে হবে। তাহলে বন্ডিংটা ভালো হবে। বিম কলাম জয়েন্টের স্ট্রেন্থ বাড়বে। এ ছাড়া আরও অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। কংক্রিটে ভালো স্ট্রেন্থ থাকলে ভেতরের রড বেশি শক্তি পায়। একটি স্ট্রাকচারের প্রায় ৫০ শতাংশ ওজন হয় কংক্রিটে। হাই গ্রেড কংক্রিট ব্যবহার করলে স্ট্রাকচারের ওজন অনেক কমে যায়। স্ট্রাকচারের ওজন কমলে ভূমিকম্পের সময় টিকে থাকতে বেশি সহায়ক হবে। সর্বোপরি ভূমিকম্পসহনীয় একটা গাইডলাইন তৈরি করা দরকার। যেন এটা মাঝে মাঝে ইমপ্রুভ করতে পারি।


ড. মো. জয়নুল আবেদীন: অধ্যাপক, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
যেকোনো স্থাপনা নির্মাণে এর ভিত্তি একটি অপরিহার্য অংশ। ভূমিকম্প মাটির অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সৃ্ষ্টি করে। ভূমিকম্পের সময় মাটির ভয়েডের মধ্যে পানির উপস্থিতি থাকলে প্রচণ্ড ঝাঁকুনির জন্য উচ্চ পানিচাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাটির দৃঢ়তা কমে যায়। মাটি তরল আকার ধারণ করে। এমন মাটি স্থাপনার ভার সহ্য করতে পারে না। এ ধরনের মাটির ওপর স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই মাটির গুণাগুণ ঠিক না থাকলে একটি ইমারত দেখতে যত ভালো হোক না কেন, তা নিরাপদ হতে পারে না। কোনো মাটি সদ্য ভরাট হলে, মাটি স্তরের উচ্চতা বেশি হলে, মিহি দানাযুক্ত মাটির পরিমাণ কম হলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে ।


ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান: সাবেক মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মতো সক্ষমতা বাংলাদেশ এখনো অর্জন করেনি। ভূমিকম্প মোকাবিলার মতো ইকুইপমেন্ট ও জনবলের অভাব আছে। বাংলাদেশে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণবিধি না মেনে ভবন নির্মিত হচ্ছে। ভূমিকম্প হলে শুধু ভবন ভেঙেই পড়বে না, আগুন লাগার আশঙ্কাও রয়েছে। তাতে পরিস্থিতি আরও ভীষণ খারাপ হবে।

সবাইকে অনুরোধ করব, ভবন নির্মাণের সময় নির্মাণবিধি যেন সঠিকভাবে পালন করেন। অগ্নিনির্বাপণ বিধি সম্পূর্ণভাবে পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।


ড. এম শামিম জেড বসুনিয়া: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এডোবি অব কনসালট্যান্টস লিমিটেড
১৯৯৩ সালে বিএনবিসি (বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ বিধি) প্রকাশ পায়। ২০০৬ সালে গেজেট আকারে সবার সামনে আসে। ২০১৫ সালে এর নতুন সংস্করণ হয়। কিন্তু এটা প্রকাশ করা হয়নি। নতুন কোড অনুসরণ করা হবে কি না, এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। নতুন বিল্ডিং কোডকে দ্রুত গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে, যেন প্রকৌশলীদের মাঝে কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে। এখন থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে প্রকাশ করতে হবে। শুধু ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন বিষয়ের নকশা করে দিলেই হবে না, প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্মাণবিধি ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে কি না, সেটা তদারক করতে হবে। প্রায়ই একটা অভিযোগ শোনা যায় যে প্রকৌশলীরা ওপরের দিকে যেতে চান না। কোথায় কীভাবে নির্মাণ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা সেটা দেখেন না। কেবল নির্মাণশ্রমিকদের ওপর নির্ভর করলে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সরাসরি তদারক করতে হবে।


মোহাম্মদ আবু সাদেক:
আমরা এত সময় বিজ্ঞ আলোচকদের আলোচনা শুনলাম। এই আলোচনা থেকে অনেক তথ্য–উপাত্ত এসেছে। এসব আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো:

এক. বাংলাদেশে ও এর আশপাশে যেসব ভূতাত্ত্বিক ফাটল আছে, তা থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।

দুই. ১৮৯৭ সালের মতো ভূমিকম্প এখন হলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হবে।

তিন. ১৯৯৩ সালে ভবন নির্মাণবিধি হলেও এখনো সঠিকভাবে এর প্রয়োগ হচ্ছে না।

চার. ভবন নির্মাণ বিধি প্রয়োগ করতে বাধ্য করার জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নেই।

পাঁচ. ভবন নির্মাণ বিধি নিয়মিত সংস্করণের জন্য স্থায়ী কমিটি থাকা জরুরি।

ছয়. নতুন ভবন নির্মাণ বিধিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দ্রুত এটা কার্যকর করা প্রয়োজন।

সাত. ভূমিকম্পসহনশীলতার জন্য এমএস রডের গুণাগুণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আট. একটি নিরাপদ আধুনিক ভবন নির্মাণের জন্য ভবন নির্মাণ বিধি, ২০২০ একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ।

নয়. মানসম্পন্ন কংক্রিট ভবনকে ভূমিকম্পসহনীয় ও ব্যয়সাশ্রয়ী করে।

দশ. সদ্য ভরাট করা মাটি এবং সেই মাটিতে মিহিদানা কম থাকলে সঠিক পরীক্ষা করে ভবন নির্মাণ করতে হবে।

এগারো. একটি ভূমিকম্পসহনীয় গাইডলাইন থাকা দরকার।

বারো. পূর্বপ্রস্তুতি ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা কমাতে পারে।

তেরো. তদারক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে।

চৌদ্দ. বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন অটো শাটডাউনের আওতায় আনা উচিত।

পনেরো. আপৎকালীন পরিকল্পনা থাকা দরকার।