করোনার সংক্রমণ কার্যকরভাবে রোধ করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

মহামারি পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যকরভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারছে না। মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া মানদণ্ড পুরোপুরি ব্যবহার করছে না বাংলাদেশ। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা কেউ বলতে পারছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে—মহামারি কি নিয়ন্ত্রণে, সংক্রমণ আবার মাথাচাড়া দিলে তা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি প্রস্তুত এবং নতুন রোগী শনাক্তকরণ ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত (কনট্যাক্ট ট্রেসিং) করার সামর্থ্য কি আছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি যেমন আছে, তেমনি আছে সর্বাত্মক উদ্যোগের অভাব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি প্রস্তুতিবিষয়ক কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি একটি সেমিনারে দেওয়া উপস্থাপনায় তিনি বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। নিজেদের নিরাপদে রাখতে হলে ন্যূনতম কাজগুলো করতে হবে। তবে তিনি আলাদা করে এ বিষয়ে প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজে–কলমে এ বছরের জানুয়ারি থেকে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। ১ ফেব্রুয়ারি ৩১২ জন প্রবাসী বাংলাদেশি ও শিক্ষার্থীকে চীন থেকে ফেরত এনে ঢাকায় হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করার মধ্য দিয়ে সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। ৩ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি সরকারের আছে। এর পাঁচ দিন পর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। গতকাল শুক্রবার নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৭১ জন। এ নিয়ে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়াল।

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং আট সদস্যবিশিষ্ট পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, মহামারি পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

>আপনাআপনি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, মানসম্পন্ন চিকিৎসা ও রোগতাত্ত্বিক নজরদারি জরুরি
দেশে এই তিনটিরই ঘাটতি আছে

মহামারি পরিস্থিতির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্যদেশগুলোকে করোনা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা বিষয়ে নানা নির্দেশনা ও পরামর্শ দিচ্ছে। এ বছরের ১৪ এপ্রিল সংস্থাটি কোভিড–১৯ পরিস্থিতি সামাল দিতে জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক উদ্যোগের ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশিকা প্রকাশ করে। তারও প্রায় এক মাস পর ১২ মে নির্দেশিকার সংযোজনী প্রকাশ করে তারা। তাতে প্রশ্নগুলো রয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশ মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিছু দেশ নিয়ন্ত্রণের পথে রয়েছে। কোনো দেশে নতুন সংক্রমণ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন দেখা যাচ্ছে। আস্থার সঙ্গে দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ নিতে পারছে না। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার তিন মাস পরে এসে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলক লকডাউন (অবরুদ্ধ) শুরু হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতিতে এই পদক্ষেপ কত দিনে কী ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় আছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের (সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ) জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। বাকি বিষয়ে কথা বলার জন্য তিনি আইইডিসিআরের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনার সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মহামারি নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশে মহামারি পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে এর উত্তর পাওয়া যাবে। কোনো দেশে সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর তিন সপ্তাহ পর তা ৫০ শতাংশ কমে গেলে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আবার দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমিত ব্যক্তির হার ৫ শতাংশের কম হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে ধরে নেওয়া যায়। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার ইঙ্গিত দেয়। এ থেকে বোঝা যাবে যে শনাক্তকরণ পরীক্ষাসহ সংক্রমণ প্রতিরোধের উদ্যোগের কারণে সংক্রমণ কমেছে।

বাংলাদেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে, তার সঠিক তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা আইইডিসিআরের কাছে নেই। সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে কবে নাগাদ পৌঁছাবে, তা কেউ বলতে পারছে না। রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গবেষক বলেছেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে, আক্রান্তের হারও একই থাকছে। পরীক্ষায় গড়ে ২০ শতাংশ আক্রান্ত বলে শনাক্ত হচ্ছে। পরীক্ষা দ্বিগুণ বাড়ানোর পর যদি আক্রান্তের হার কমতে দেখা যায়, তখনই পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যাবে।

বিশ্বের যে ১০টি দেশে বর্তমানে দৈনিক শনাক্ত বেশি হচ্ছে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় আছে। একাধিক দেশি ও বিদেশি জনস্বাস্থ্যবিদ বলেছেন, সরকার সংক্রমণের যে তথ্য প্রকাশ করছে, বাস্তব সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষা ও সংক্রমিত ব্যক্তির তথ্যে নানা ফাঁকফোকর আছে বলে মনে করেন সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, এটা বলা যাবে না। কারণ, সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই–ই বাড়ছে। অন্যদিকে মহামারি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়, এটাও বলা যাবে না। কারণ, সরকার সংক্রমণ প্রতিরোধে আগেও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল, নতুন করে আবার ব্যবস্থা নিচ্ছে। গৃহীত ব্যবস্থায় ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তবে সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে, এটা বলার সুযোগ নেই।

হাসপাতালের প্রস্তুতি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোনো দেশ কোভিড রোগী ও নন–কোভিড রোগীর চিকিৎসায় কী করছে, তা ওই দেশের প্রস্তুতির মানদণ্ড। এ ক্ষেত্রে সব কোভিড রোগীকে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে কি না, তা একটি বড় প্রশ্ন। অন্য প্রশ্নটি হচ্ছে, মারাত্মক অসুস্থ নন–কোভিড রোগীরা দেশীয় মান অনুযায়ী চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে মৃত্যু বেড়েছে কি না কিংবা প্রতিটি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে কি না।

কোভিড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার মান পর্যবেক্ষণ ও তদারকির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শুরু থেকে চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা গেছে। পাশাপাশি নন–কোভিড রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এমন অভিযোগও আছে। এই সময় মৃত্যু বেড়েছে কি না, সেই তথ্য জানা যায়নি। তবে সব হাসপাতালে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।

দেশে এ পর্যন্ত ৮১ হাজার ৫২৩ জন করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। গতকাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৯ হাজার ১২ জন, আর বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৫৪ হাজার ১৬৭ জন। বাড়িতে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।

তবে চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে সরকার ইতিমধ্যে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়েছে। আরও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

জনস্বাস্থ্য নজরদারি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিটি দেশের পর্যাপ্তসংখ্যক রোগ শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরি থাকতে হবে। পাশাপাশি নির্ভরযোগ্যভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরীক্ষার কৌশল থাকতে হবে। কার্যকর নজরদারি ও পর্যবেক্ষণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা জরুরি। কাজটিকে তিন ভাগে ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

প্রথমত, ভৌগোলিকভাবে সব এলাকার ও ঝুঁকিতে থাকা সব ধরনের মানুষের মধ্যে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালাতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে, প্রাথমিক সেবাকেন্দ্রে, হাসপাতালে এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা নজরদারি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অব্যাহত রাখতে হবে। হাসপাতালে ও কমিউনিটিতে করোনায় কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার তথ্য রাখতে হবে। প্রতিদিন কত পরীক্ষা হচ্ছে এবং কত আক্রান্ত হচ্ছে, তার হিসাব রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রোগী শনাক্ত করার জন্য সব স্তরে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণকারী দলকে সক্রিয় থাকতে হবে। সন্দেহভাজন ৯০ শতাংশ ব্যক্তিকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) রাখতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে বা ছেড়ে দিতে হবে। এটা সম্ভব হলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব।

তৃতীয়ত, রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। কমপক্ষে ৮০ শতাংশ নতুন রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। নতুন রোগীর সংস্পর্শে আসা কমপক্ষে ৮০ শতাংশ ব্যক্তিকে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের তথ্য ও অন্যান্য তথ্যের জন্য বিশেষ তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।

দেশে রোগী শনাক্ত করার দুর্বলতা শুরু থেকেই ছিল। শুরু থেকে কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের কিছু কাজ করত আইইডিসিআর। মাঝপথে আইইডিসিআরের কাছ থেকে দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়া হয়। কার্যকরভাবে সেই কাজ কবে শুরু হবে, তা কেউ জানে না। তবে এখন পরীক্ষাকেন্দ্র বেড়েছে। গতকাল ৫৯টি কেন্দ্রে পরীক্ষার কথা জানানো হয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ কথাও বলেছে যে মহামারি সামাল দিতে পুরো সরকারব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এটা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত না করলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।