করোনাকালে কৃষিই বড় ভরসা

সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মইনুল ইসলাম, দেবাশীষ রায়, সাদেকা হালিম, খুশী কবির ও শামসুল হুদা
সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মইনুল ইসলাম, দেবাশীষ রায়, সাদেকা হালিম, খুশী কবির ও শামসুল হুদা

করোনা সংকটের এই সময়ে কৃষিই সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হতে হবে কৃষি। তাই কৃষির উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য প্রয়োজন কার্যকর ভূমি সংস্কার। কৃষিনীতি ও কৃষিজমি সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে।

প্রথম আলো ও বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল রোববার বেলা ১১টায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ‘কৃষির উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও নারীর অবদান’ শীর্ষক এই বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর ডিজিটাল স্টুডিওতে। অতিথিরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন। প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে বৈঠকটি সরাসরি প্রচার করা হয়।

বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের ফলেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। কৃষির এই উন্নয়নকে ধরে রাখতে সরকার আগামী ৫০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এ জন্য ভূমি আইন পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং খাসজমির জন্য একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে। কৃষিতে নারীর অবদানকে স্বীকৃত দেওয়ার ব্যাপারেও সরকার কাজ করছে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত এক যুগে দেশের কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটে গেছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর কৃষি উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা এবং সরকারের সঠিক নীতির কারণে এই সফলতা এসেছে। চাল, আলু, সবজি ও মাছের মতো প্রধান খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এমনকি চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, স্বাদুপানির মাছে তৃতীয়, ফল ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে। এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ কৃষক ভূমিহীনে পরিণত হয়েছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ধনিকশ্রেণি আর দুর্নীতিবাজ আমলা-রাজনীতিবিদেরা বিপুল পরিমাণে জমি কিনে রেখে দিয়েছেন। ফলে ভূমি সংস্কার না করলে কৃষির উৎপাদনশীলতা ধরে রাখা যাবে না।

করোনায় সরকারের দেওয়া বিশেষ সহায়তা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ কম পাচ্ছে উল্লেখ করে রাঙামাটির চাকমা সার্কেলের প্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পাহাড়ে খাবারের সংকট রয়েছে। বিপুল পরিমাণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী করোনার কারণে কাজ হারিয়েছে। আবার শহর থেকে যাঁরা এলাকায় ফিরেছেন, তাঁদের অনেকে কাজ পাচ্ছেন না। তাঁদের জন্য সরকারের খাদ্যসহায়তা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, দেশের ভূমির মালিকানার ৯৪ শতাংশ পুরুষ। বাকি ৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী। আবার কৃষিমজুরদের ৭০ শতাংশের বেশি নারী। কিন্তু নারীরা পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পাচ্ছেন। এই বৈষম্য দূর করতে হবে।

এর আগে বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে কৃষিকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।

বৈঠকে বেসরকারি সংগঠন ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, আমন ধানের মৌসুম আসছে সামনে। ফসল যাতে ভালো হয়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু সরকার এ নিয়ে কী করছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

দেশে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি সে উৎপাদন কত দিন ধরে রাখা যাবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী দেশের প্রান্তিক কৃষকদের কৃষিজমি দখল করে নিচ্ছে। অন্যদিকে একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করায় মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কৃষি উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কৃষিজমি সুরক্ষা আইন দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, করোনার অভিজ্ঞতা থেকে এটি স্পষ্ট যে সামনের দিনে কৃষি ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এই কৃষিকাজের প্রায় পুরোটাই এখন নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীনির্ভর। এই জনগোষ্ঠীর কাজের আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। আর আগামী দিনের উন্নয়নে কৃষিকে কেন্দ্রে রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শফিক উজ জামান বলেন, বাংলাদেশের কৃষি খাতকে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কৃষিপণ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। না হলে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পাবেন না।

গ্রামে দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে সরকারিভাবে যে খাসজমি বণ্টন করা হচ্ছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সত্যিকারের দরিদ্ররা পাচ্ছেন না বলে উল্লেখ করেন এলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান। তিনি বলেন, অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জমি খাস হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। বন বিভাগ থেকেও তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য নীতিমালা করা দরকার। সমতল ও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন না হলে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে না।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।