দেশে করোনার সংক্রমণ আরও তীব্র হচ্ছে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

চতুর্থ মাসে এসে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে অন্তত দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে।

গত ৯ জুন থেকে শুরু হওয়া সংক্রমণের চতুর্থ মাসের প্রথম ৮ দিনে মৃত্যুর দৈনিক গড় প্রায় ৪২। আর গড়ে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সংক্রমণ শনাক্তের ১০১তম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে।

গতকাল নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা) ৩ হাজার ৮৬২ জনের দেহে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। এ সময়ে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ২৩৭ জন।

>এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের নতুন রেকর্ড। চতুর্থ মাসের প্রথম ৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৪২ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত তিন হাজারের বেশি।

গতকালের আগ পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ ৪৬ জনের মৃত্যু এবং ৩ হাজার ৪৭১ জন শনাক্তের তথ্য ছিল। গতকাল প্রথমবারের মতো এক দিনে মৃত্যু ৫০ ছাড়ানোর তথ্য দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মৃত্যু ও সংক্রমণ বৃদ্ধির চিত্র

দেশে ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের কথা জানায় সরকার। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ সংক্রমণে প্রথম মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হয়। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা ছিল অনিয়মিত। ৬ এপ্রিল থেকে দেশে করোনায় মৃত্যু একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু নিয়মিত হওয়ার প্রথম এক মাস (৯ মে পর্যন্ত) দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ১০–এর মধ্যে সীমিত ছিল।

এখন পর্যন্ত সরকার করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ১ হাজার ২৬২ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে চতুর্থ মাসের প্রথম আট দিনে মারা গেছেন ৩৩২ জন, যা মোট মৃত্যুর এক–চতুর্থাংশের বেশি। এর বাইরে শুরু থেকে প্রতিদিন কোভিড-১৯–এর উপসর্গ নিয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার মানুষ মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে, যাঁদের বেশির ভাগেরই নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি।

বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও। সংক্রমণের দশম সপ্তাহে দৈনিক রোগী শনাক্তের গড় ছিল ১ হাজার ৩২। আর চলতি ১৪তম সপ্তাহের প্রথম তিন দিনে গড়ে ৩ হাজার ৩৬৭ জন রোগী চিহ্নিত হয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২১৫ দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বেড়েছে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১১তম। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৮তম। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ৩১তম।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক রোগতত্ত্ববিধ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোক বলেন, তাঁদের পূর্বানুমান সঠিক না হলেই খুশি হতেন। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে মৃত্যু ও আক্রান্ত—দুটোই আরও বাড়বে। সামনে উদ্বেগের সময় আসছে। সক্রিয়ভাবে সংক্রমণ থামানোর উদ্যোগ না নিলে সংক্রমণ নিজ থেকে কমবে না। বাস্তবতা বিবেচনায় হয়তো সারা দেশে লকডাউন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত কার্যকর লকডাউন বা স্বাস্থ্যবেষ্টনী তৈরি করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ স্থিতিশীল হবে।

সংক্রমণ ঠেকাতে পদক্ষেপ

সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। সারা দেশে কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে করোনা সংক্রমণের প্রথম কেন্দ্রস্থল চীনের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা ছিল ঢিলেঢালা। ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা এবং ইফতারি বিক্রির দোকান খুলে দেওয়া হয়। তখন থেকে লকডাউন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ঢিলেঢালা হতে শুরু করে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণের দশম সপ্তাহ (১০ থেকে ১৬ মে) থেকে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখা যায়।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওই ঢিলেঢালাভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে সংক্রমণ পরিস্থিতিতে। এর মধ্যে গত মাসের শেষের দিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে যাতায়াত করেছেন। কেনাকাটার জন্য দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়। ঈদের পর গত ৩১ মে থেকে লকডাউনও উঠে গেছে। প্রায় সব অফিস–আদালত খুলে গেছে। জুনের মাঝামাঝি গিয়ে ঈদের সময়ের ঢিলেঢালা ভাব এবং লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রভাব দেখা যাবে এবং মৃত্যু ও সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত শনাক্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে।

এখন সংক্রমণ ঠেকাতে কিছুদিন ধরে সরকার এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কথা বলছে। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন চলছে। রাজধানীর অন্যান্য এলাকা ও সারা দেশে লকডাউন কবে থেকে কোথায় শুরু হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। পূর্ব রাজাবাজারে যেভাবে লকডাউন করা হয়েছে, তার সফলতা নিয়েও প্রশ্ন আছে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মধ্যে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন, দেশে সংক্রমণের একটি পিক (চূড়ান্ত পর্যায়) চলছে। এটা কমাতে লকডাউনে যেতে হবে। একটি এলাকায় শুধু যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াটাই লকডাউন নয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের অর্থ হলো ওই এলাকার সব আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন রাখা) রাখতে হবে। একটি আলাদা হলরুমে তাঁদের রাখা যায়। আক্রান্তদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করতে হবে। সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করতে হবে। মোট ২৮ দিন এভাবে চলার পর আরও ১০ দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পূর্ব রাজাবাজারে এসব কতটুকু কী করা হচ্ছে, কী ফল পাওয়া যাচ্ছে, তা খোলাসা করা উচিত। শুধু যাতায়াত বন্ধ করে দিয়ে ফল পাওয়া যাবে না।