বিএসএমএমইউর সুপারিশের বাস্তবায়ন চান জাফরুল্লাহ চৌধুরী

জাফরুল্লাহ চৌধুরী।  ফাইল ছবি
জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ছবি

অনেক তর্কবিতর্ক আর পানি ঘোলার পর বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট উদ্ভাবনের সাফল্য প্রমাণিত হয়েছে। গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রাথমিক অগ্রগতিতে সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি ১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি পেয়েছেন। রাত নয়টায় পড়ছিলেন। বলেছেন, আগামীকাল শনিবার অ্যান্টিজেন কিট (যেটি দিয়ে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারিজ চেইন রিঅ্যাকশন বা আরটিপিসিআরের মতো দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যাবে) বিএসএমএমইউতে জমা দেবেন।

এখন ডা. জাফরুল্লাহ মনে করেন, বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক তাদের উদ্ভাবিত কিটের বিষয়ে ৭০ শতাংশ কার্যকারিতার বিষয়টি উল্লেখ করা বড় নয়। এখন বড় কথা হলো বিএসএমএমইউর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা। তিনি এখন ঔষধ প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

এর আগে জানতে চাওয়া হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেছিলেন, ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলে তিনি নিবন্ধন দেবেন। এমনকি বিশেষজ্ঞ কমিটিতেও পাঠাবেন না।

এটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ডা. জাফরুল্লাহ জানিয়েছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্যের নামকরণ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আবার বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা আরেক প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ বিএসএমএমইউর বিশেষজ্ঞ দল গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের কার্যকারিতার প্রমাণ পেয়েছেন।

এখন দরকার দ্রুত অগ্রসর হওয়া। গণস্বাস্থ্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে জাতির এক মহাদুর্যোগের দিনে ১৭ কোটি মানুষের জীবনে সরাসরি একটি সুসংবাদ বয়ে এনেছে। সবারই অভিনন্দন প্রাপ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই একটা আশা নিয়ে গণস্বাস্থ্যের জন্য কতগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাও ফলপ্রসূ হয়েছে।

কিছুদিন ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমন দুর্দিনে আমাদের দেশের পটভূমিতে এই যে সাফল্য, তা সচেতন বিবেকবান মহলের মানুষ খুব বড় করে দেখেন। তাঁরা বলেন, ‘কী কী ব্যর্থতা, কী কী নিন্দা–মন্দ, সেটা আমরা পুনরায় না খুলি। এখন দৃশ্যটা এ রকম হোক, ঔষধ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিদেশের দূতাবাসগুলো, যেখানে যে আছে, সবার কাজ হোক, অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের কাজে লাগাতে পদক্ষেপ নেওয়া। যা যা দরকার, তাই তাই করা হোক। লালফিতা যাতে ক্ষণকাল হরণ করতে না পারে।’

এই কিটের জনকেরাও বলছেন, কিটের উন্নয়ন একটি চলমান বিষয়। তবে বিএসএমএমইউ আনুষ্ঠানিকভাবে যা বলেছে, সেটাই হোক ভিত্তি।

তবে বিএসএমএমইউ কেন একটি ইতিবাচক বিষয়কে নেতিবাচক বিষয় হিসেবে জাতির সামনে পেশ করল, সেটা পর্যালোচনার দাবি রাখে।

চুক্তির বিচ্যুতি

প্রথমত, এটা ছিল একটা গবেষণা। কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষায় দুটি গবেষণা সংস্থার মধ্যে তাই চুক্তি হয়েছিল। দুই পক্ষের মধ্যে গত ২ মে পাঁচ বছর মেয়াদে একটি ‘কনফিডেনশিয়ালিটি অ্যান্ড নন–ডিসক্লোজার’ (গোপনীয়তা ও প্রকাশ না করা) চুক্তি সই হয়। এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে কোনো প্রেস রিলিজ দেওয়ার আগে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা দরকার ছিল।

এমনকি চুক্তি না থাকলেও প্রতিষ্ঠিত সৌজন্যের রীতি সেটাই দাবি করে। কী প্রক্রিয়ায় টেস্ট করা হবে, সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য বিজন কুমার শীল ও তাঁর দল একাধিকবার বিএসএমএমইউতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এরপর ১৭ জুন এমনভাবে প্রকাশ করা হলো, তাতে জ্ঞানচর্চার আমেজটা থাকল না। দৃশ্যত একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপার হলো। কোনো চা পানের আমন্ত্রণ ছিল না। ১৮ জুন বিএসএমএমইউ নীরবে ১৯ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি গণস্বাস্থ্যের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। গবেষণালব্ধ একটি বিরাট অর্জনের কোনো উদ্‌যাপন নেই। যদিও বিবৃতি বলেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নির্মিত কিট পরীক্ষা করতে পেরে তারা আনন্দিত। কিন্তু নেতিবাচকভাবে প্রকাশের ধরনে অনেক মিডিয়াকর্মীও বিভ্রান্ত হলেন।

 ভুল দিয়ে ফল প্রকাশ

১৭ জুন দেওয়া বিএসএমএমইউর বিবৃতিতে তিনটি দফা ছিল। এর মধ্যে একটি প্রাসঙ্গিক। অন্য দুটি কার্যত জনগণের কাছে প্রকাশ করার বিষয় ছিল না।

এর ফলে অনাবশ্যকভাবে নেতিবাচকতা প্রাধান্য পেয়েছে। একটি ইতিবাচক বিষয় নেতিবাচকভাবে ফুটে উঠেছে। বিবৃতির শুরুটা ভুল দিয়ে: ‘এই কিটটি উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রোগ শনাক্তকরণে কার্যকরী নয়।’ এর কোনো দরকার ছিল না। কারণ তাঁরা জানতেন, লালা দিয়ে অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষার কাজ করে এই কিট। যার পরীক্ষা গণস্বাস্থ্যই স্থগিত করেছিল। সুতরাং শনাক্ত করতে পারে না, বলাটা ছিল অবান্তর। বিএসএমএমইউর কার্যপরিধির বাইরের বিষয়। উপরন্তু, সবারই জানা যে অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জন্মানোর পরের বিষয়।

অবশ্য কেউ একে ব্যবহারিক অর্থে শনাক্তকরণ কিট বলতেও পারেন। কারণ, ‘উপসর্গ নিয়ে আসা’র কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। উপসর্গ না থাকা ব্যক্তিও করোনা পজিটিভ হন। এ রকম কেউ দেরিতে অ্যান্টিবডি টেস্ট করাতে পারে। তখন তিনি প্রকারান্তরে পজিটিভ স্বীকৃত হবেন। 

বিবৃতিটি এরপর বলেছে, ‘উপসর্গের প্রথম দুই সপ্তাহে এই কিট ব্যবহার করে শুধু ১১ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর রোগ শনাক্তকরণ সম্ভব।’ প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সূত্র হলো, কারও দেহে ভাইরাস সংক্রমণের ৭ থেকে ১০ দিন পরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে। তাই ভিন্ন নমুনা ও প্রক্রিয়ায় এই ফল ভিন্ন হতে পারে।

এরপর বিবৃতি বলেছে, ‘তবে যে সমস্ত স্থানে প্রচলিত আরটি পিসিআর পদ্ধতি চালু নেই, অথবা যাদের উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও আরটি পিসিআর নেগেটিভ এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক।’ দেশের ৬৪ জেলা ও ৪৫৮টি উপজেলার কোথাও আরটিপিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেশে, এ রকম মন্তব্য সমীচীন ছিল কি? অবশ্য তারা এটাও স্বীকার করল যে পিসিআর যেখানে ব্যর্থ, গণস্বাস্থ্যের কিট সেখানে সফল হবে। সুতরাং সেই একই মুখে কিটের সহায়ক ভূমিকাকে এভাবে গুরুত্বহীন করে দেখানোর দরকার ছিল না।

১০০% স্বীকৃতি!

বিবৃতির দ্বিতীয় নম্বরে বলেছে, এটা রোগের ব্যাপ্তি বা সেরোপ্রিভালেন্স (সাধারণ জনগণের মধ্যে অ্যান্টিবডির হার) বোঝা যাবে। এটা দিয়ে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা ৭০ শতাংশ বোঝা যাবে। এটা প্লাজমা বিতরণ, কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন তুলতে কাজে লাগবে।

এক অর্থে গণস্বাস্থ্যের গবেষক দল ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছে। গণস্বাস্থ্যের গবেষকেরা বলছেন, কিটের উন্নয়ন অব্যাহত প্রচেষ্টার বিষয়। তাঁরা তাঁদের পরীক্ষায় ৮৮ শতাংশ সাফল্য পেয়েছিলেন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, সংকট দু–তিন বছর চলবে। সুতরাং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের ব্যাপ্তি ইত্যাদি ৭০ শতাংশের কম বোঝাটাও একটি মাইলফলক অগ্রগতি।

সম্মিলিত অ্যান্টিবডিই মুখ্য

বিএসএমএমইউর বিবৃতির ৩ নম্বর পর্যবেক্ষণ বলেছে, ‘অ্যান্টিবডি শনাক্ত করতে পারলেও আইজিএম (যা ইনফেকশনের শুরুতেই তৈরি হয়) এবং আইজিজি (ইনফেকশনের বিলম্বিত পর্যায়ে তৈরি হয়) তা আলাদাভাবে পার্থক্য করতে পারে না।’ গণস্বাস্থ্য কিট প্রকল্পের সমন্বয়ক মুহিব উল্লাহ খন্দকার বললেন, আরটিপিসিআর উপসর্গ আসার পর থেকে ১০ দিন পর্যন্ত গড়ে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে। তাঁরা যেটা চাইছেন, সেটা চাইলে আমরাও করতে পারি। তবে অতিমারিতে সম্মিলিত অ্যান্টিবডি নির্ণয়ই মুখ্য।

১০ হাজার মিনিটের বিল

বিএসএমএমইউর বিবৃতি বলেছে, ‘এক মাসের এই গবেষণা কার্যক্রমে গবেষণা দল পারিশ্রমিক নেননি।’ এটি শুধু অধ্যাপক তাবাসসুমের নেতৃত্বাধীন কমিটির ছয় সদস্যের জন্য প্রযোজ্য। এই কমিটিই এক হাজার কিটে (৫০০ অ্যান্টিজেন, ৫০০ অ্যান্টিবডি) নমুনা পরীক্ষার জন্য ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকার বাজেট দিয়েছিল। এই খরচের মধ্যে ৭ দিনে টেস্ট শেষ করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, টেকনোলজিস্ট ও সহকারীদের ভাতা হিসেবে ২ লাখ টাকার বেশি, ৫৬ সেট পিপিই বাবদ ১ লাখ টাকার বেশি এবং মুঠোফোন সেটসহ ১০ হাজার মিনিট কথা বলার চার্জ হিসেবে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা ধরেন। পুরো টাকাই গণস্বাস্থ্য শোধ করেছে।