স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্ধারিত হাসপাতালটি চালু হবে কবে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে নির্মাণাধীন হাসপাতাল।  গত মঙ্গলবার মহাখালীতে। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে নির্মাণাধীন হাসপাতাল। গত মঙ্গলবার মহাখালীতে। ছবি: প্রথম আলো

করোনা মোকাবিলার সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালটি কবে চালু হবে, তা কেউ বলতে পারছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গত ঈদের আগেই হাসপাতালটি চালু করার কথা বলেছিলেন। এখন বলছেন, আগামী মাসে চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় চলমান ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এই হাসপাতাল তৈরি করার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা শাখা। অবকাঠামো নির্মাণ, চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় ও স্থাপন, চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ শেষে কবে নাগাদ এই হাসপাতাল চালু হবে, তা নিশ্চিত নয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এর বাইরে আরও একজন চিকিৎসক মারা গেছেন বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪০ জন। নার্স, টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন আরও প্রায় আড়াই হাজার।

 চিকিৎসক ও নার্সনেতারা তাঁদের জন্য পৃথক হাসপাতালের দাবি করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সুস্থ হয়ে চিকিৎসকদের দ্রুত চিকিৎসার কাজেই ফিরে যেতে হবে, তাই তাঁদের পৃথক হাসপাতাল দরকার।

চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য আলাদা হাসপাতাল হওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইসমত আরা।

>চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা চিকিৎসায় পৃথক হাসপাতাল দরকার
সময় পার হয়ে যাচ্ছে
হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে না<

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ইকবাল কবির করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেছেন, দাতাদের নিয়মকানুনের কারণে সহজে হাসপাতাল সামগ্রী কেনা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন। তিনি আরও বলেন, আগামীকাল ২০ জুন এই হাসপাতাল থেকে প্রাথমিকভাবে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হবে। জুলাই থেকে হাসপাতাল পুরোদমে চালু হবে বলে আশা করা যায়।

প্রকল্প বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে যোগাযোগ করে কারও মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে করোনা মোকাবিলায় দাতাদের কাজ সমন্বয়ের সঙ্গে জড়িত একজন পরামর্শক বলেছেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় দাতারা অতি দ্রুততার সঙ্গে অর্থ ছাড় করেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সময়মতো সেই অর্থ কাজে লাগাতে পারছে না।

সরেজমিন হাসপাতাল

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে এই হাসপাতাল হবে। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা হবে ৫০টি। এর জন্য বরাদ্দ ছিল ৬২ কোটি টাকা।

রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশেই সিটি করপোরেশনের এই মার্কেট। ১৬ জুন দুপুরে মার্কেটে গিয়ে একটি ব্যানার চোখে পড়ে। তাতে লেখা: অস্থায়ী কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য পরিচর্যা (আইসোলেশন) কেন্দ্র। সাড়ে ছয়তলা ভবনের ছয়তলায় এই হাসপাতাল হচ্ছে। নিচের তলাগুলো আইসোলেশন কেন্দ্র করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ছয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু শ্রমিক নির্মাণকাজ করে চলেছেন। কেউ ইটের দেয়াল তুলছেন, কেউ কাচঘেরা ঘরে বিদ্যুতের তার সংযোগের কাজে ব্যস্ত। কয়েকটি বড় কক্ষে বেশ কিছু শয্যা চোখে পড়ল। এগুলো নতুন কেনা। কিছু বাক্স চোখে পড়ল, তাতে কী আছে জানা গেল না। এক পাশে তিনটি বুথ দেখা গেল। এসব বুথ নমুনা সংগ্রহের জন্য। একজন ব্যবস্থাপক গোছের ব্যক্তির কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিলেন, হাসপাতালের কাজ কবে শেষ কবে? তাঁর উত্তর ছিল, ‘কমপক্ষে এক মাস সময় তো লাগবেই।’

একটি বিশাল মার্কেটের ওপরের তলায় বেশ খোলা জায়গায় দেয়াল তুলে হাসপাতাল করা হচ্ছে। কোথাও কোনো টয়লেট বা গোসলখানা চোখে পড়ল না। মার্কেটের দায়িত্বে থাকা ডিএনসিসির একজন কর্মচারী বলেন, ‘এডা মার্কেট। ওপরের তালা বানানো হইছিল গুদামের জন্যি, হাসপাতালের জন্যি না।’

বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য পৃথক হাসপাতালের কথা বলে আসছিলাম। কিন্তু কখনো ভাবিনি যে হাসপাতালটি হবে এমন জায়গায়।’

সবার আগ্রহ ছিল

এই হাসপাতাল করার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতো বিশ্ব ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তারও আগ্রহ ছিল। এপ্রিল ও মে মাসে বিশ্ব ব্যাংক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া কয়েকটি চিঠি থেকে তা জানা যায়। 

জানা গেছে, এপ্রিলের শুরুতে দুজন ব্যবসায়ী মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে ‘টার্ন কি’ শর্তে পুরো হাসপাতাল করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর অর্থ একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে, ওই প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও কেনাকাটাসহ হাসপাতাল সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে দেবে। দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব যায় বিশ্ব ব্যাংকের কাছে। বিশ্ব ব্যাংকের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, হাসপাতালের পুরো কাজ রাজধানীর শ্যামলীর একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা এগিয়েছিল। শ্যামলীর ওই প্রতিষ্ঠান লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছিল।

সেই প্রস্তাবের ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের কিছু কর্মকর্তার আগ্রহও ছিল। ১৮ এপ্রিলের চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চায় বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু অন্য একটি চিঠিতে দেখা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের ওয়াশিংটন কার্যালয় একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, শ্যামলীর প্রতিষ্ঠানটি ভেন্টিলেটরসহ ৫০টি আইসিইউ শয্যা সরবরাহ করার কথা বলেছিল। গুদামে এসব দেখতেও গিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা।

শ্যামলীর ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। কিছু নির্মাণকাজও করেছিলাম। কিন্তু কেন হঠাৎ বাদ পড়লাম, জানি না।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা ৬০ কোটি টাকায় কাজ করতে চেয়েছিলেন। 

এপ্রিল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ সরঞ্জাম কেনার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রকল্প পরিচালক ইকবাল কবির বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কেনাকাটায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তিনি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি। 

অন্যদিকে কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম কয়েক গুণ বেশি দামে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন একটি একটি পালস অক্সিমিটার (রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পাশাপাশি হৃৎস্পন্দন পরিমাপ করার যন্ত্র) ৩০ হাজার টাকার বেশি দাম দিয়ে কেনা হচ্ছে। সাধারণত সাড়ে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা দামের যন্ত্র সারা দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইকবাল কবির বলেন, অর্থদাতারা তাদের মান অনুযায়ী এসব কিনে দিচ্ছে। 

কবে চালু হবে হাসপাতাল

হাসপাতাল তৈরির কী কাজ হয়েছে জানতে চাইলে ইকবাল কবির বলেন, ‘বেড রেডি, অক্সিজেন সাপ্লাই রেডি হচ্ছে। সব যন্ত্রপাতি এ মাসের মধ্যে এসে যাবে।’ আইসিইউ শয্যা ও ভেন্টিলেটর কেনার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও দাতারা এ বিষয়ে সহায়তা করছে।

তবে অক্সিজেনের ব্যাপারে দাতা সংস্থার একজন প্রতিনিধি বলেছেন, করোনা রোগীর জন্য যে মানের অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা থাকা দরকার, তা আগামী দুই মাসেও সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। অন্য কেনাকাটার ব্যাপারেও এক মাসের বেশি সময় লেগে যাবে। তিনি বলেন, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা কেনাকাটার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা করছে।

শুধু অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি দিয়ে চিকিৎসা হবে না। দরকার চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ড বয়। ইকবাল কবির দাবি করেছেন, এই হাসপাতালের জন্য ৮৭ জন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আউট সোর্সিং করা হবে।

পেশাজীবী চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতাল যখন চালু হবে, তখন হয়তো করোনার প্রকোপই থাকবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে এটা হয়েছে। সরকারের উচিত এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।