স্ত্রীর লাশ নিয়ে সারা রাত চায়ের দোকানে

হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় নিজের ছোট্ট এই চায়ের দোকানে স্ত্রীর লাশ এনে রাখেন জলিল আকন। ঝাটিবুনিয়া আলেপের খেয়াঘাট এলাকা, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী। ১৯ জুন। ছবি: জাকির হোসেন
হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় নিজের ছোট্ট এই চায়ের দোকানে স্ত্রীর লাশ এনে রাখেন জলিল আকন। ঝাটিবুনিয়া আলেপের খেয়াঘাট এলাকা, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী। ১৯ জুন। ছবি: জাকির হোসেন

কহিনুর বেগম তিন–চার দিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অচেতন অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মির্জাগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টার দিক তাঁর মৃত্যু হয়। বাইরে তখন বৃষ্টি। লাশ নিয়ে রাখার জায়গা না থাকায় স্বামী জলিল আকন সকালে লাশটি নিতে চাইলেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জোর করে একটি অটোতে তুলে পাঠিয়ে দেয় লাশ। কোনো উপায় না দেখে জলিল তাঁর ছোট্ট চায়ের দোকানেই স্ত্রীর লাশ নিয়ে আসেন। পাশে বসে থাকেন সারা রাত।
জলিল আকনের বসতঘরটি গত ১৪ মে আগুনে পুড়ে যায়। এরপর তিনি স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে অন্য একজনের বাড়ির বৈঠকখানায় থাকছিলেন। করোনা–আতঙ্কে সেখানে লাশ নেওয়ার বিষয়ে অন্যদের আপত্তি থাকায় তিনি তাঁর চায়ের দোকানে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন।
সকালেও কেউ এগিয়ে না আসায় জলিল নিজেই স্ত্রীর লাশ গোসল করান। পরে স্থানীয় মো. মিজানুর রহমান এবং সুবিদখালী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মাহবুব আলমের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে ওই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন।
ঘটনাটি ঘটেছে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে।
জলিল আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী কহিনুর বেগমের (৩৫) কয়েক দিন যাবৎ পাতলা পায়খানা হয়েছে। তাকে বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টার দিকে মারা যায়। আমার বাড়িতে ঘর নেই। গত মাসে আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। অন্যের বাড়িতে থাকি। স্ত্রীর লাশ সকালে আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলাম রাতেই একটি অটোতে করে লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে।’
এ ব্যাপারে দায়িত্বরত চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা সব মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই দাফন-কাফনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বলি। জোর করে তাঁকে (জলিল আকন) লাশ দেওয়া হয়নি। বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁর সঙ্গে লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, হাসপাতালে লাশ থাকলেই ঝামেলা, মানুষ কোভিড-১৯ সন্দেহ করে। কোভিড-১৯ না হলেও পুলিশকে অবহিত করা, নমুনা সংগ্রহ করা ইত্যাদি নানা বিষয় ঝামেলা পোহাতে হয়। এ কারণেই হাসপাতাল থেকে লাশ তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিলরুবা ইয়াসমিন বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মধ্যে রাতে লাশ বাড়িতে পাঠানো উচিত হয়নি। শুনেছি, ওই নারীর বাড়ি কয়েক দিন আগে আগুনে পুড়ে গেছে। আমি যখন বিষয়টি জেনেছি, তখন লাশ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ওই নারী ইউরিনারি ইনফেকশনজনিত রোগে ভুগছিলেন।’
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মো. আবু বকর ছিদ্দিকী বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এহেন আচরণে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে রাত ১১টায় ফোন করে বলেছিলাম লাশ পরের দিন হস্তান্তর করতে। কিন্তু তাঁরা রাতেই লাশ পাঠিয়ে দিয়েছেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’